প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে আছে এক বিশ্বাস
সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অরণ্যজুড়ে শতাব্দী পেরিয়ে আসা এক আস্থা এখনও অটুট। সময়ের সঙ্গে বদলেছে নদী-খাঁড়ির রূপ, বদলেছে জীবিকার ধরন, কিন্তু বদলায়নি জঙ্গলজীবীদের বিশ্বাস। মৎস্যজীবী, মধু সংগ্রহকারী কিংবা কাঠুরিয়া—সবার কাছে আজও আশ্রয়ের নাম ‘বনবিবি’। জঙ্গলে প্রবেশের আগে নদী পেরোনোর সময় হোক কিংবা গভীর অরণ্যের ভেতরে, তাঁকে স্মরণ না করে কেউ এগোয় না। আজও ছোট ছোট বনবিবির মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে খাঁড়ির ধার জুড়ে।
এক দরিদ্র মা-ছেলের কাহিনিই বিশ্বাসের ভিত্তি
লোককথায় প্রচলিত রয়েছে বনবিবি পূজার পেছনে এক হৃদয়স্পর্শী গল্প। সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করত এক দরিদ্র বিধবা মা ও তাঁর ছোট ছেলে দুখে। সংসারে অভাব ছিল প্রবল, কিন্তু মাতৃস্নেহে বড় হচ্ছিল দুখে। সেদিনও গ্রামের অন্য সব শিশুর মতো তার শৈশব কাটছিল মায়ের আঁচল আঁকড়ে। সেই সংসারের গল্পই আজও প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিশ্বাসের শেকড় হয়ে আছে।
কাকার লোভে পথ হারানো দুখে
দুখের দুই জ্ঞাতি কাকা—ধনা ও মনা। একদিন তারা মধু আহরণের অজুহাতে দুখেকে সঙ্গে নিয়ে যায় জঙ্গলে। বিদায়ের আগে মা ছেলেকে বলেছিলেন—“বনে আমার মতোই আরেক মা আছেন, বিপদে পড়লে তাঁকে ডাকিস।” সেই কথাই হয়ে উঠেছিল দুখের একমাত্র ভরসা। কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পরেই সব বদলে যায়। ধনা-মনা স্বপ্নে দেখেছিল দক্ষিণ রায়কে—জঙ্গলের অধিপতি, যিনি বাঘের রূপে প্রকাশিত হয়ে তাঁদের বিপুল সম্পদের লোভ দেখান। শর্ত ছিল, দুখেকে তাঁকে উৎসর্গ করতে হবে।
লোভে অন্ধ দুই ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতা
অঢেল সম্পদের প্রলোভনে পড়েই ধনা-মনা অমানবিক সিদ্ধান্ত নেয়। তারা দুখেকে জলের জন্য পাঠিয়ে নৌকা থেকে চুপিসারে পালিয়ে যায়। অসহায় দুখে বুঝতে পারে, তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। চারদিক অন্ধকার, সামনে বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ের আতঙ্ক, আর পিছনে বিশ্বাসঘাতক কাকার ছায়া—এই সঙ্কটে একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠেন সেই অদৃশ্য ‘মা’, যার কথা মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
আর্তির উত্তর দেন বনবিবি
দুখে তখন হাতজোড় করে বনবিবির কাছে প্রার্থনা করে। কিংবদন্তি বলছে, দেবী বনবিবি তাঁর আর্তি শুনে মর্ত্যে আবির্ভূত হন। বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে দুখেকে রক্ষা করেন তিনি। এরপর এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয় সুন্দরবন। দেবী দুখেকে কুমিরের পিঠে ভাসিয়ে নিরাপদে মায়ের কোলে পৌঁছে দেন। বিশ্বাসীরা বলেন, সেই মুহূর্তে জন্ম নেয় এক অনন্ত আস্থা, যা আজও জঙ্গলজীবীদের প্রাণভরসা।
প্রজন্মের পর প্রজন্মে বেঁচে থাকা আরাধনা
এই অলৌকিক ঘটনার পর থেকেই দুখে ও তাঁর মা বনবিবিকে দেবীরূপে পূজা করতে শুরু করেন। ধনা-মনা নিজেদের লোভ আর কুকর্মে লজ্জিত হয়ে পড়ে। তারপর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সুন্দরবনের জঙ্গলজীবীরা বনবিবিকে রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে মান্য করছে। মধু সংগ্রহে বেরনোর আগে হোক, বাঘ-আতঙ্কিত বনের ভেতর ঢোকার আগে হোক—আজও বনবিবির আশীর্বাদ ছাড়া কোনো জঙ্গলজীবী সাহস করে না।
আজও জঙ্গলের প্রতিটি যাত্রায় বনবিবির ডাক
সময় পাল্টেছে, মোবাইল টাওয়ার দাঁড়িয়েছে খাঁড়ির ধারে, নৌকায় এসেছে মোটর ইঞ্জিন, কিন্তু বিশ্বাস আজও একই রকম। সুন্দরবনের জঙ্গলে প্রবেশের আগে প্রতিটি মৎস্যজীবী বা মৌচাক সংগ্রাহক বনবিবির উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালান, প্রসাদ দেন, প্রার্থনা করেন। তাঁদের বিশ্বাস, বনবিবি না থাকলে জঙ্গলে টিকে থাকা অসম্ভব। প্রতিটি যাত্রার শুরুতেই আজও উচ্চারিত হয় দেবীর নাম।