বিশ্বের সুপরিচিত ইলেকট্রিক গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা টেসলা তাদের এপ্রিল-জুন মাসের অর্থাৎ দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের (Q2) ফলাফল প্রকাশ করেছে, যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটাই দুর্বল। কোম্পানির মোট আয় ১২ শতাংশ কমে ২২.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে গত বছর একই ত্রৈমাসিকে এই সংখ্যা ছিল ২৫.৫ বিলিয়ন ডলার। লাভের কথা বললে, তা ১.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ১.১৭ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে, যা ১৬ শতাংশ হ্রাস।
আয় হ্রাসের এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ বেড়েছে। একইসঙ্গে, কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (adjust basis) মাত্র ৪০ সেন্ট হয়েছে। এই পরিসংখ্যান এমন সময়ে এসেছে যখন টেসলা ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
অটো ব্যবসায় সবচেয়ে বড় পতন, ডেলিভারিতেও ভারী পতন
টেসলার সাম্প্রতিক ফলাফলে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে তাদের প্রধান অটোমোবাইল ব্যবসার উপর। এই অংশের আয় ১৬.৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে গত বছর ছিল ১৯.৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ টেসলার গাড়ি বিক্রি বেশ কমেছে। রেগুলেটরি ক্রেডিট থেকে আয় প্রায় অর্ধেক হয়ে ৪৩৯ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা গত বছর ছিল ৮৯০ মিলিয়ন ডলার।
কোম্পানি এই ত্রৈমাসিকে মোট ৩.৮৪ লক্ষ ইলেকট্রিক গাড়ি ডেলিভারি করেছে, যা বছর-ভিত্তিক ১৪ শতাংশ কম। এই পতন এমন সময়ে এসেছে যখন বিশ্ব বাজারে ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা নিয়ে প্রত্যাশা বাড়ছে।
সুপারচার্জার ও সার্ভিস সেগমেন্ট থেকে সামান্য স্বস্তি
যেখানে অটো ব্যবসা কোম্পানির আয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, সেখানে সার্ভিস সেগমেন্টে কিছুটা স্বস্তি দেখা গেছে। এই বিভাগে সুপারচার্জিং স্টেশন, গাড়ির মেরামতের পরিষেবা এবং অন্যান্য আফটার-সেলস পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত। এই বিভাগের গ্রস প্রফিট ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
কোম্পানি এই সময়ে ২,৯০০টি নতুন সুপারচার্জার স্টল যুক্ত করেছে, যার ফলে এর বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন টেসলার ৭,৩০০টির বেশি চার্জিং স্টেশন রয়েছে। এটি একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে কোম্পানির বৃদ্ধি বজায় ছিল।
রাজনৈতিক বিতর্কে খারাপ হয়েছে ব্র্যান্ডের ভাবমূর্তি
টেসলার আয় কমে যাওয়ার পেছনে শুধু ব্যবসার কারণই নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও কোম্পানিকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এলন মাস্কের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউরোপে জার্মানির দক্ষিণপন্থী দল AfD-কে সমর্থন করার বক্তব্য সামনে এসেছে।
এই বক্তব্যের পর টেসলা নিয়ে অনেক দেশে অসন্তোষ দেখা গেছে। ব্র্যান্ডের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার প্রভাব গাড়ির বিক্রিতেও পড়েছে। এলন মাস্ক এর আগেও রাজনৈতিক কথাবার্তা নিয়ে আলোচনায় ছিলেন, কিন্তু এইবার তার প্রভাব কোম্পানির ফলাফলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
নতুন নীতি ও শুল্কে বেড়েছে সমস্যা
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমেরিকাতে চাপানো নতুন শুল্ক টেসলার সাপ্লাই চেইনকে প্রভাবিত করেছে। কোম্পানিকে তার কিছু যন্ত্রাংশ এবং অ্যাসেম্বলি লোকেশন পরিবর্তন করতে হয়েছে, যার ফলে উৎপাদন এবং ডেলিভারিতে বাধা এসেছে।
কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (CFO) বৈভব তানেজা সতর্ক করেছেন যে আগস্টের শেষ থেকে ডেলিভারিতে আরও সমস্যা হতে পারে। এর পাশাপাশি আমেরিকাতে পাশ হওয়া “Big Beautiful Bill” আইনের কারণে টেসলার গাড়িতে পাওয়া $৭,৫০০-এর ট্যাক্স ক্রেডিট সেপ্টেম্বরের পর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাব গাড়ির দাম এবং বিক্রির উপর পড়বে।
এলন মাস্কের বয়ান – “কঠিন সময় আসতে পারে”
আয়ের দুর্বল পরিসংখ্যান প্রকাশের পর একটি কলে টেসলার সিইও এলন মাস্ক বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে বলেছেন যে আগামী কিছু ত্রৈমাসিক “কঠিন হতে পারে”। তিনি বলেন যে কোম্পানিকে সাপ্লাই চেইন, নতুন নীতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
তবে, মাস্ক এই ভরসা দিয়েছেন যে আগামী বছরের শেষ নাগাদ টেসলার আর্থিক অবস্থা “খুব আকর্ষণীয়” হতে পারে, যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তার উদ্বেগ লুকানো নেই।
শেয়ার বাজারে পড়ল টেসলার দর
টেসলার দুর্বল ফলাফল এবং মাস্কের বিবৃতির পর কোম্পানির শেয়ার আফটার-আওয়ার্স ট্রেডিংয়ে ৪.৫ শতাংশের বেশি কমে গেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
বিগত কয়েক মাস ধরে টেসলার শেয়ারে অস্থিরতা চলছে, কিন্তু এইবার পতনের কারণ কোম্পানির মৌলিক অবস্থানে দুর্বলতা। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আগামী ত্রৈমাসিকে ডেলিভারি এবং আয় উন্নত না হয়, তবে টেসলার জন্য পথ আরও কঠিন হতে পারে।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুঝছে টেসলা
টেসলা এই মুহূর্তে শুধু আমেরিকাতেই নয়, ইউরোপ এবং এশিয়াতেও প্রতিযোগিতা এবং নীতিগত পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্ছে। চীনে দেশীয় কোম্পানিগুলির দ্রুত বৃদ্ধি এবং ইউরোপে EV ভর্তুকি হ্রাস-এর মতো কারণগুলি কোম্পানির বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।