স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির মতে ঈশ্বরের পূজার তিনটি সহজ উপায়

স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির মতে ঈশ্বরের পূজার তিনটি সহজ উপায়

আধ্যাত্মিক জগতে স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি এক জন প্রখ্যাত সাধু হিসাবে পরিচিত। তিনি শিব ভক্ত হিসাবে পরিচিত এবং ক্রমাগত সমাজকে ধর্ম ও ভক্তির প্রকৃত স্বরূপের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করে চলেছেন। সম্প্রতি তিনি ভগবানের পূজার তিনটি প্রধান উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন কোন পথে সাধক ভগবানের সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারে।

পূজার উদ্দেশ্য শুধু লোক দেখানো নয়, আত্মিক শুদ্ধি

স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির মতে ভগবানের পূজা কেবল ঐতিহ্য পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। এটি একটি আত্মিক প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তির মধ্যে শক্তির সঞ্চার করে এবং তাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে। তিনি বলেন যে পূজার মূল উদ্দেশ্য হল আত্মার শুদ্ধি এবং চেতনার বিস্তার, শুধু লোক দেখানোর জন্য মালা জপা বা প্রদীপ জ্বালানো নয়।

ভক্তি মার্গকে কঠিনতম, কিন্তু সবচেয়ে ভাবপূর্ণ বলেছেন

স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি প্রথমে 'ভক্তি মার্গ' এর ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন যে ভক্তির অর্থ কেবল মন্ত্র এবং ভজন গাওয়া নয়, বরং এতে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের অনুভূতি থাকতে হবে। ব্যক্তি যখন তার ভেতরের অহংকার ত্যাগ করে, নম্রতা এবং সেবার মনোভাব নিয়ে ঈশ্বরের ধ্যান করে, তখনই তা সত্যিকারের ভক্তি হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, "ভক্তি মার্গ কঠিন কারণ এতে কেবল ভগবানকে ভালবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং প্রতিটি জীবের মধ্যে ঈশ্বরের দর্শন করতে হয়। জীব সেবাই নারায়ণ সেবা। কোনও ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেওয়া, কোনও দুঃখীকে সাহায্য করা – এই সমস্ত কাজ ঈশ্বরের ভক্তিরই অংশ।"

জ্ঞান মার্গ: আত্ম-সাক্ষাৎকারের পথ

দ্বিতীয় পথটি হল 'জ্ঞান মার্গ' – স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির মতে এই পথ সেই সাধকদের জন্য যারা গভীর চিন্তা এবং আত্ম-বিশ্লেষণে আগ্রহী। জ্ঞান মার্গে ব্যক্তি নিজেকে জানার চেষ্টা করে – ‘আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, এবং এই জীবনের উদ্দেশ্য কী।’

এই পথ নির্জনতা, নীরবতা এবং অবিরাম মননের পথ। এতে শাস্ত্রের অধ্যয়ন, গুরুদের সেবা এবং আত্মচিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি এই পথে চলে, সে ধীরে ধীরে সাংসারিক মোহ থেকে উপরে উঠতে শুরু করে এবং আত্মার অনুসন্ধানে মগ্ন হয়ে যায়।”

কর্মকাণ্ড মার্গ: কর্মকে পূজা মানার পথ

স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি তৃতীয় পথ 'কর্মকাণ্ড মার্গ'কে সাধনার সরল কিন্তু কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে এই পথ শুধুমাত্র পূজা-পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এতে প্রতিটি কাজ ঈশ্বরকে উৎসর্গীকৃত মনোভাবের সাথে করার কথা বলা হয়েছে।

ভগবদ্গীতাতে যে 'নিষ্কাম কর্ম যোগ'-এর কথা বলা হয়েছে, সেটাই এই পথের আত্মা। অর্থাৎ, ব্যক্তি তার কর্তব্যগুলি সম্পূর্ণ নিষ্ঠা ও সততার সাথে পালন করবে, কিন্তু ফলের চিন্তা না করে।

তিনি বলেন, “কর্মের পথ সবার জন্য খোলা। একজন কৃষক যখন মাঠে পরিশ্রম করে, একজন শিক্ষক যখন বাচ্চাদের পড়ায়, একজন ডাক্তার যখন রোগীর চিকিৎসা করে, যদি এই সকলে তাদের কর্মকে ভগবানের সেবা মনে করে করে, তবে সেটাই তাদের পূজা হয়ে যায়।”

সবচেয়ে সরল পথ কোনটি? জেনে নিন স্বামী কৈলাশানন্দের উত্তর

যখন স্বামী কৈলাশানন্দ গিরিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে সরল পথ কোনটি, তখন তিনি বলেন যে কর্মকাণ্ড বা কর্ম যোগ সবচেয়ে সহজ এবং সকলের জন্য সম্ভব। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তি, সে যে কোনও পটভূমিরই হোক না কেন, নিজের কর্তব্য পালন করতে পারে।

তাঁর মতে, “কর্ম করা ব্যক্তি প্রতিটি পরিস্থিতিতে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তার কোনও বিশেষ পদ্ধতি বা জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। কেবল নিষ্ঠা, সততা এবং সেবার মনোভাব জরুরি।”

ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন খাঁটি অনুভূতি

স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি জোর দিয়ে বলেন যে যে পথই বেছে নেওয়া হোক না কেন, তাতে সত্যতা, পবিত্রতা এবং অকৃত্রিম অনুভূতি থাকা উচিত। পূজার কোনও নির্ধারিত নিয়ম নেই, তবে অনুভূতি শুদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, “ঈশ্বরকে বাইরের বস্তু দিতে হয় না, তিনি চান আপনার মন ও অনুভূতি। যদি মন নির্মল হয় এবং শ্রদ্ধা গভীর হয়, তবে যে কোনও পথ সফল হতে পারে।”

সমাজ পেল এক নতুন দৃষ্টিকোণ

স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির এই ব্যাখ্যা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে পূজা শুধু মন্দিরে যাওয়া বা ব্রত রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি জীবন যাপনের একটি পদ্ধতি, যা আপনার কর্ম, আপনার চিন্তা এবং আপনার আচরণের সাথে জড়িত।

এই আলোচনার পরে অনেক ধর্মীয় মঞ্চে ভক্তি ও কর্মযোগ নিয়ে আলোচনা আরও জোরদার হয়েছে। মানুষ জানতে চাইছে যে শুধু মন্দিরে গিয়ে পূজা করাই যথেষ্ট, নাকি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ঈশ্বরকে উৎসর্গ করাই আসল সাধনা।

সবার জন্য একটি পথ

স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির কথা থেকে এটিও স্পষ্ট হয় যে প্রত্যেক মানুষের প্রকৃতি আলাদা হলেও, ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর কোনও না কোনও পথ তার জন্য বিদ্যমান। কেউ জ্ঞানের মাধ্যমে, কেউ সেবার মাধ্যমে, কেউ ভক্তির মাধ্যমে – প্রতিটি পথ মানুষকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।

Leave a comment