ভারত-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ: ওয়াশিংটন থেকে নয়াদিল্লি, দুই দেশের কূটনৈতিক অন্দরে ঝড় তুলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। তাঁর বিস্ফোরক অভিযোগ—ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি পাকিস্তানে পরিবারের ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ভারত-মার্কিন সম্পর্ককেই আঘাত করেছিলেন।দীর্ঘদিনের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব ও কৌশলগত সহযোগিতাকে ব্যক্তিগত কারণে ত্যাগ করার এই অভিযোগ বিশ্বমহলে গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সুলিভানের মুখে ট্রাম্পের নীতি প্রশ্নের মুখে
প্রাক্তন মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পদে থেকে একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রথম দায়িত্ব দেশকে শক্তিশালী কূটনৈতিক জোট উপহার দেওয়া। অথচ ট্রাম্প পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক চুক্তি পাকিস্তানের সঙ্গে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য গোটা আমেরিকার বৈদেশিক নীতিকে কি এভাবে বদলে দেওয়া যায়?
‘ভারতকে পাশে রাখার কথা ছিল আমেরিকার’
সুলিভান তাঁর বক্তব্যে স্মরণ করিয়ে দেন, কয়েক দশক ধরে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় শাসনই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছে। প্রযুক্তি, প্রতিভা, অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা—সব ক্ষেত্রেই ভারত ছিল গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বিশেষ করে চিনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের যৌথ কৌশল এক অপরিহার্য বাস্তবতা হিসেবে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প এই বাস্তবতাকে পিছনে ঠেলে পাকিস্তানের দিকেই ঝুঁকলেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থই মূল কারণ?
অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে ট্রাম্প পরিবারের পাকিস্তান-যোগ। সুলিভানের মতে, ইসলামাবাদের সঙ্গে ট্রাম্প পরিবারের রিয়েল এস্টেট এবং বিনিয়োগ চুক্তির কারণেই ট্রাম্প হঠাৎ পাকিস্তান-ঘেঁষা নীতি নিতে শুরু করেছিলেন। অথচ একই সময়ে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করছিল। এই সিদ্ধান্তে শুধু ভারত নয়, আমেরিকারও কৌশলগত ক্ষতি হয়েছে।
রাশিয়ার তেল নিয়ে দ্বন্দ্বের আবহ
ভারত-আমেরিকা সম্পর্কে অবনতির আরেকটি বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে রাশিয়া প্রসঙ্গ। ট্রাম্প প্রশাসন বরাবরই ভারতের রাশিয়া থেকে ছাড়ে অপরিশোধিত তেল কেনার নীতিকে আক্রমণ করেছে। যদিও ইউরোপ বা চিনকে নিয়ে একই ধরনের সমালোচনা করা হয়নি। ফলে নয়াদিল্লি এই দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলেছিল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি বাড়তি নমনীয়তাও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্টের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব নিতেও এগিয়েছিলেন ট্রাম্প
সুলিভান আরও জানান, ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাতের পরে যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব নিতে শুরু করেছিলেন ট্রাম্প। অথচ নয়াদিল্লি বারবার পরিষ্কার করে বলেছে, যুদ্ধবিরতি তাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল, কোনও বিদেশি নেতার মধ্যস্থতার জন্য নয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন বারবার ভারতকে একপ্রকার কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে।
‘বৃহৎ কৌশলগত ক্ষতি’—সুলিভানের বিশ্লেষণ
প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শুধুই একটি রাজনৈতিক ভুল নয়, বরং এটি ছিল আমেরিকার জন্য এক বিশাল কৌশলগত ক্ষতি। তাঁর কথায়, “ভারতের সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক গড়ে তুললে তা শুধু আমেরিকার প্রতিরক্ষা নয়, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলত। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে এই সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর ভরসা করতে দ্বিধা করছে।”
মার্কিন রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক
সুলিভানের এই মন্তব্যে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছে মার্কিন রাজনীতিতে। রিপাবলিকান শিবিরের একাংশ অবশ্য এই অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের দাবি, ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাননি, বরং ভারতের তেল কেনার নীতি নিয়ে স্বচ্ছতার দাবি তুলেছিলেন। তবে ডেমোক্র্যাট শিবির বলছে, প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য প্রমাণ করছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন দেশকে নয়, পরিবারের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।
ভবিষ্যতের প্রভাব : বিশ্ব রাজনীতিতে এই বিতর্ক দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২৪-পরবর্তী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে থেকেই ট্রাম্পকে ঘিরে নানা বিতর্ক সামনে এসেছে। এবার ভারতকে ‘ত্যাগ’ করে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকতে চাওয়ার অভিযোগ তাঁর ভাবমূর্তিকে আরও কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ স্থির হবে আসন্ন প্রশাসনের সিদ্ধান্তে। তবে এই মুহূর্তে সুলিভানের অভিযোগ গোটা বিশ্বে এক বড় রাজনৈতিক কাঁপন তুলেছে।ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ শুধুই ব্যক্তিগত নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত ও আমেরিকার সম্পর্ক শুধু দুই দেশের স্বার্থে নয়, গোটা এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য। সেই সম্পর্ককে যদি এক ব্যক্তির পরিবারের ব্যবসায়িক স্বার্থে ত্যাগ করতে হয়, তবে তা কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক নজির হয়ে থাকবে।