ট্রাম্পের রাশিয়াকে চাপ দিতে ভারত ও চীনের ওপর ১০০% শুল্কের প্রস্তাব। ইইউ এটি খারিজ করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ভারত ও ইইউ-এর মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক: আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার বিরুদ্ধে চাপ বাড়ানোর জন্য ভারত ও চীনের ওপর ১০০% শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, এতে রাশিয়ার তেল রপ্তানির ওপর বড় প্রভাব পড়বে, কারণ ভারত ও চীন রাশিয়ার বৃহত্তম ক্রেতা। তবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
আসলে, ট্রাম্প মঙ্গলবার সরাসরি ইইউ-এর প্রতিনিধি ডেভিড ও'সুলিভানের এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ইইউ প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন পৌঁছেছিল রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। কিন্তু ইইউ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ভারত ও চীন উভয় দেশের ওপর এই ধরনের কঠোর শুল্ক আরোপ করা বাস্তবসম্মত নয়।
নিষেধাজ্ঞা ও শুল্কের পার্থক্য
এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে ইইউ নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ককে ভিন্নভাবে দেখে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া ও তদন্তের প্রয়োজন হয়, যাতে তার ভিত্তি শক্তিশালী হয়। অন্যদিকে, শুল্ক সরাসরি বাণিজ্য ও দামের ওপর প্রভাব ফেলে।
এখন পর্যন্ত ইইউ রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে আসা কৃষি পণ্য ও সারের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। কিন্তু ভারত বা চীনের ওপর ১০০% শুল্ক আরোপ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। ইইউ কর্মকর্তাদের মতে, নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানিকে লক্ষ্যবস্তু করা বেশি সহজ। যদি তারা রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর সাথে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়, তবে তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও করা যেতে পারে।
জুলাইয়ে নতুন নিষেধাজ্ঞা
জুলাই ২০২৫-এ ইইউ রাশিয়ার ওপর বেশ কিছু নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এর মধ্যে ভারতের নয়ারা এনার্জি রিফাইনারি এবং চীনের দুটি বড় ব্যাংকের নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইইউ মনে করে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নিষেধাজ্ঞা বেশি কার্যকর হয়, অন্যদিকে পুরো দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করলে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।
ভারত-ইইউ বাণিজ্য সম্পর্ক
ভারত ও ইইউ-এর মধ্যে বর্তমানে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। দুই দেশের মধ্যে একটি বড় বাণিজ্য চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কৃষি, দুগ্ধজাত পণ্য এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে যাতে চুক্তিটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কার্যকর করা যায়।
গত ২০ বছরে ভারত ও ইইউ-এর মধ্যে বাণিজ্য তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে ভারত, ইইউ-এর সপ্তম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, ইইউ ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম আমদানি অংশীদার।
বাণিজ্যের পরিসংখ্যান
প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (PIB) অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে ভারত ও ইইউ-এর মধ্যে মোট পণ্যের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৩৭.৪১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। এই হিসেবে ইইউ ভারতের বৃহত্তম পণ্য বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।
শুধু পণ্য নয়, পরিষেবার ক্ষেত্রেও ভারত ও ইইউ-এর মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী। ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে পরিষেবার বাণিজ্য ছিল ৫১.৪৫ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপীয় কমিশনের মতে, ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে পরিষেবার মোট বাণিজ্য ছিল ৫৯.৭ বিলিয়ন ইউরো। তবে, এতে ইইউ-কে ৭.৯ বিলিয়ন ইউরোর লোকসান ভোগ করতে হয়েছে। ভারত থেকে ইইউ-তে প্রধানত যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, রাসায়নিক, ধাতু, খনিজ এবং টেক্সটাইল রপ্তানি হয়। অন্যদিকে, ইইউ থেকে ভারতে প্রধানত যন্ত্রপাতি, যানবাহন এবং রাসায়নিক আমদানি করা হয়।
ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর
ভারত ও ইইউ-এর মধ্যে সহযোগিতা শুধু বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (India-Middle East-Europe Economic Corridor) চালু করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য হলো ভারতকে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করা।
এই প্রকল্পে আমেরিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বড় দেশগুলোও জড়িত। করিডোরের পথ ফ্রান্সের মার্সেই বন্দরের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে, গাজা সংঘাতের কারণে এই প্রকল্পে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
ইইউ কেন শুল্কের সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যাচ্ছে
ইইউ-এর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভারত ও চীন উভয়ই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। পুরো দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করার অর্থ হবে কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য সরাসরি প্রভাবিত হওয়া।
ইইউ কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাই সেরা পথ। এইভাবে তারা রাশিয়ার মিত্রদের ওপর সীমিত প্রভাব ফেলতে পারে এবং একই সাথে ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর সাথে তাদের বড় বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে।