মধ্য প্রদেশের উজ্জয়ীন জেলায় সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যা কেবল আইন-শৃঙ্খলার অবক্ষয় ঘটায়নি, বরং সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কার এবং তন্ত্র-মন্ত্রের কালো ছায়া উন্মোচন করেছে। এটি কোনো সিনেমার গল্প নয়, বরং সত্য ঘটনা যেখানে রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভে কিছু লোক কবরস্থান থেকে মৃতদেহ তুলে এনে তান্ত্রিক ক্রিয়া করেছে।
ঘটনাটি উজ্জয়ীন জেলার খাচারোদ থানা এলাকার গ্রাম ডোডিয়ার, যেখানে ২৫শে ফেব্রুয়ারি রাতে এক গ্রামবাসীর দ্বারা কিছু তান্ত্রিককে ডাকার পর, গ্রামের কবরস্থান থেকে একটি মৃতদেহ তোলা হয়। ঘটনাটি প্রকাশ হয় যখন সকালে গ্রামবাসীরা কবরগুলি খোলা দেখে পুলিশকে খবর দেয়। তদন্তে জানা যায় যে, পুরো ঘটনাটি তন্ত্র-মন্ত্র ও কালো জাদু দ্বারা সম্পর্কিত, যার উদ্দেশ্য ছিল তান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা লাভ করা।
কালো জাদুর ফাঁদ: লোভের গল্প
কুসংস্কার এবং লোভ যখন একত্রিত হয়, তখন মানুষ মনুষ্যত্বের সীমা অতিক্রম করে যায়। ডোডিয়া গ্রামের কাচরু চন্দ্রবংশী শিবরাত্রির একদিন আগে তার বাড়িতে কিছু তান্ত্রিককে ডেকেছিলেন। শোনা যাচ্ছে, তিনি কালো জাদুর একটি বিশেষ তান্ত্রিক পদ্ধতি করানোর জন্য তাদের ডেকেছিলেন, যেখানে মানুষের মৃতদেহের প্রয়োজন ছিল।
তান্ত্রিকদের কথামতো রাতের অন্ধকারে কবরস্থানে একটি কবর খোঁড়া হয় এবং সেখান থেকে মৃতদেহটি তোলা হয়। সকালে যখন গ্রামবাসীরা খোঁড়াখুঁড়ি করা কবরগুলো দেখতে পায়, তখন পুরো গ্রামে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পরে। পরিবার ও গ্রামবাসীরা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেয়।
পুলিশের কঠোর ব্যবস্থা
ঘটনাটি জানতে পেরেই খাচারোদ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং তদন্ত শুরু করে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ধনসিং নালওয়া ঘটনা স্থলে যান এবং তদন্ত শুরু করেন। তিনি গ্রামের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখা শুরু করেন। ফুটেজে কিছু সন্দেহজনক কার্যকলাপ ধরা পরে, যা থেকে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া যায়।
গোয়েন্দাদের দেওয়া খবর এবং ফুটেজের ভিত্তিতে পুলিশ তিনজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে একজন অভিযুক্ত ডোডিয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং অন্য দুজন রাজস্থানের বাঁসওয়াড়া জেলার বাসিন্দা। পুলিশ অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে যে, তারা তান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে ধন-সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে এই কাজ করেছে।
কবরস্থান থেকে কুয়ো পর্যন্ত: কঙ্কাল উদ্ধার
পুলিশ তদন্ত আরও এগিয়ে নিয়ে একটি পুরনো কুয়োয় তল্লাশি অভিযান চালায়, যেখানে মানব কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানবদেহের অঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশ মানব কঙ্কালের সঙ্গে জড়িত থাকার, কবর থেকে মৃতদেহ চুরি এবং কুসংস্কার ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে।
প্রশাসনের বার্তা এবং সমাজের দায়িত্ব
এসডিওপি পুষ্পা প্রজাপতি এই পুরো ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এটি অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা যা সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের সত্যতা তুলে ধরে। তিনি বলেন, মানুষ যেন এই ধরনের ভণ্ড তান্ত্রিকদের ফাঁদে পা না দেয় এবং এই ধরনের কুসংস্কার থেকে দূরে থাকে।
তিনি আরও জানান, পুলিশ প্রশাসন এই ধরনের কাজে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এছাড়াও, তিনি সমাজের কাছে আবেদন করেন, যদি কোথাও এই ধরনের সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দিন।
কুসংস্কারের আড়ালে অপরাধ
এই ঘটনা কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ব্যাধির প্রতীক যা বহু বছর ধরে আমাদের সমাজে শিকড় গেড়ে বসেছে। কালো জাদু, তন্ত্র-মন্ত্র, টোটকা-তাবিজের মতো কুপ্রথা আজও অনেক গ্রাম ও শহরে সক্রিয়। মানুষের দুর্বলতা, দারিদ্র্য অথবা লোভ এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন শক্তিকে বাড়িয়ে তোলে। অনেক সময় এই ভণ্ড তান্ত্রিকরা সরল মানুষদের বিভ্রান্ত করে তাদের অপরাধের জগতে ঠেলে দেয়।
এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে – রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন এক গ্রামবাসীকে অপরাধের অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এখন সে কেবল আইনের জালে আবদ্ধ নয়, সামাজিক বদনাম এবং আত্মগ্লানির শিকারও।
উজ্জয়িনের এই ঘটনা কেবল পুলিশি কার্যকলাপে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং এটিকে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা উচিত। এখনই সময় যখন আমরা কুসংস্কারের শিকড়গুলো চিহ্নিত করব এবং তাদের উৎপাটনের জন্য সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসব। কালো জাদু এবং তন্ত্র-মন্ত্রের আড়ালে হওয়া অপরাধগুলো কেবল আইন দিয়ে নয়, সামাজিক সচেতনতা দিয়েও প্রতিরোধ করা যেতে পারে।