প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট পুরো ভারত দেশ গর্ব ও সম্মানের সঙ্গে স্বাধীনতা দিবস পালন করে। এই দিনটি শুধু একটি ঐতিহাসিক তারিখ নয়, বরং স্বাধীনতার জন্য লড়া দীর্ঘ, কষ্টকর লড়াই এবং অসংখ্য আত্মত্যাগের প্রতীক। ১৯৪৭ সালে এই দিনেই ভারত ২০০ বছরের ব্রিটিশ দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, স্বাধীনতার জন্য ১৫ই আগস্ট দিনটিই কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল? এটা কি শুধুই একটি কাকতালীয় ঘটনা ছিল, নাকি এর পেছনে কোনো কৌশল, কোনো ঐতিহাসিক তাৎপর্য লুকানো ছিল?
১৫ই আগস্ট ১৯৪৭: স্বাধীনতার সকাল, বিভাজনের কালি
১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে যখন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু 'নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎকার' (Tryst with Destiny) ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন দেশের এক অংশে স্বাধীনতার উৎসব পালিত হচ্ছিল, তো অন্যদিকে পাকিস্তান গঠনের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় ছিলেন। হাজার হাজার মানুষ সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হয়েছিলেন। তাই এই দিনটি যতটা গৌরবময় ছিল, ততটাই বেদনাদায়কও ছিল।
স্বাধীনতার সম্ভাব্য তারিখ: ৩০শে জুন ১৯৪৮
যখন ভারতকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখন ব্রিটিশ সরকারের মূল পরিকল্পনা ছিল ৩০শে জুন ১৯৪৮ সালের মধ্যে ভারতকে স্বাধীন করা। এই দিনটি এই জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল যাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এবং সুসংগঠিতভাবে সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু দেশে বাড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসা, মুসলিম লীগের আলাদা রাষ্ট্রের দাবি এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে তাকিয়ে এই তারিখটি অনেক দূরের বলে মনে হচ্ছিল। ব্রিটিশ সরকার ভয় পাচ্ছিল যে যদি সময় থাকতে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া না হয়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই প্রক্রিয়াটি তাড়াতাড়ি শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং স্বাধীনতার তারিখ এগিয়ে ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ করা হল।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিগত পছন্দ জাতীয় তারিখে পরিণত হল
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটি মজার এবং ব্যক্তিগত কারণও ছিল। আসলে, ১৫ই আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছিল। এই দিনটি মাউন্টব্যাটেনের জন্য খুবই বিশেষ ছিল, কারণ তিনি সেই সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিত্র দেশগুলোর সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার ছিলেন এবং জাপানের আত্মসমর্পণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। মাউন্টব্যাটেনের ভাষায়, 'আমি জানি না ভারতীয়রা কেন ১৫ই আগস্টকে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু আমার জন্য এটা একটা বিশেষ দিন ছিল, এবং আমি চেয়েছিলাম যে ভারতের ইতিহাসে এই তারিখটি অমর হয়ে যাক।' এভাবেই একটি ব্যক্তিগত পছন্দ ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারিখে পরিণত হল।
ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট ১৯৪৭
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ৪ঠা জুলাই ১৯৪৭ সালে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স বিল পেশ করা হয়েছিল। একে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট বলা হয়, যা ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ থেকে কার্যকর হয়েছিল। এই আইনের অধীনে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ভারতকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল, যার অর্থ ছিল ভারত এখন স্বাধীন কিন্তু ব্রিটিশ ক্রাউনের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে থেকে যাবে, যতক্ষণ না সে নিজেকে পূর্ণ প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে।
মহাত্মা গান্ধীর অনুপস্থিতি: নীরবতায় লুকানো প্রতিবাদ
যখন দেশজুড়ে স্বাধীনতার উৎসব পালিত হচ্ছিল, সেই সময় ভারতের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় সেনানী মহাত্মা গান্ধী এই উৎসব থেকে দূরে ছিলেন। তিনি না দিল্লি-র স্বাধীনতা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, না কোনো ভাষণ দিয়েছিলেন। এর বদলে তিনি নোয়াখালিতে (বর্তমানে বাংলাদেশে) হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বন্ধ করতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি নেহরু এবং প্যাটেলের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেছিলেন, 'আমি ১৫ই আগস্ট আনন্দ করে পালন করতে পারব না। আমি মিথ্যা ভান করতে পারি না। দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার সঙ্গে বিভাজনের বেদনা জড়িত হয়ে আছে।' গান্ধীজির কাছে স্বাধীনতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মানবতা, ভ্রাতৃত্ব এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
বিভাজনের মাশুল দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতা
ভারতের স্বাধীনতা একটি বড় সাফল্য ছিল, কিন্তু এর মূল্য বিভাজনের রূপে চোকাতে হয়েছিল। পাকিস্তান একটি আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি হয়েছিল। এর কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজেদের ঘর ছাড়তে হয়েছিল, হাজার হাজার মানুষ দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন এবং মহিলাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা ভারতের স্বাধীনতাকে তিক্ত স্বাদ দিয়ে গিয়েছিল। দেশকে পাওয়া স্বাধীনতা আনন্দের চেয়েও বেশি গভীর আত্মবিশ্লেষণ এবং দুঃখের বিষয় হয়ে উঠেছিল।
১৫ই আগস্ট: শুধু একটি তারিখ নয়, দায়িত্বের প্রতীক
প্রতি বছর যখন আমরা ১৫ই আগস্ট পতাকা উত্তোলন করি এবং জাতীয় সঙ্গীত গাই, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই দিনটি কেবল একটি উৎসব নয়, বরং আমাদের কর্তব্যগুলোর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার দিন। স্বাধীনতা পাওয়ার পর আসল স্বাধীনতা তখনই মানা হবে যখন আমরা সামাজিক বৈষম্য, ভেদাভেদ, অশিক্ষা, দারিদ্র্য এবং অবিচারকেও মুছে ফেলতে পারব।
স্বাধীনতার সঠিক অর্থ কী?
স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর নয়। এর মানে হল নিজের চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা, নিজের অধিকার রক্ষা করা, নিজের কর্তব্যের প্রতি সচেতন থাকা এবং প্রত্যেক নাগরিককে সমান সুযোগ দেওয়া। ১৫ই আগস্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কোনো শেষ গন্তব্য নয়, বরং একটি অবিরাম প্রক্রিয়া – একটি যাত্রা, যা ততক্ষণ পর্যন্ত শেষ হয় না যতক্ষণ না প্রত্যেক নাগরিক স্বাধীন, সুরক্ষিত এবং সমান হয়।
ভারতের স্বাধীনতার তারিখ হিসেবে ১৫ই আগস্টের নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক, কৌশলগত এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল। এটা সেই দিন ছিল যখন একটি পরাধীন দেশ নিজের ভাগ্য নিজে লেখার অধিকার পেয়েছিল। কিন্তু এই দিনটি সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কথাও মনে করিয়ে দেয় যাঁরা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন যাতে আমরা খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারি।