হিন্দুধর্মে গঙ্গা ও যমুনা, উভয় নদীকেই অত্যন্ত পবিত্র ও পূজনীয় মানা হয়। গঙ্গাজলকে তো ঘরে রাখার, পূজনে ব্যবহার করার এবং রোজকার কাজে লাগানোর পরম্পরা আছে, কিন্তু যমুনা জলের সঙ্গে তেমনটা নয়। লোকেরা যমুনা নদীতে স্নান তো করেন, তর্পণ বা ব্রতে তার ব্যবহারও করেন, কিন্তু যমুনা জলকে ঘরে সংগ্রহ করে রাখা বর্জিত মানা হয়। এই মান্যতার পিছনে ধর্মীয়, পৌরাণিক ও আধ্যাত্মিক কারণ লুকানো আছে, যা আজও লোকমানসে গভীরভাবে প্রোথিত।
যমুনা জল ও যমরাজের সম্পর্ক
পৌরাণিক গ্রন্থ অনুসারে, যমুনা দেবী সূর্যদেবের কন্যা এবং যমরাজের বোন। এই কারণে যমুনাজিকে 'যমদুহী'-ও বলা হয়। ভাইফোঁটার দিনে যমরাজ, তাঁর বোন যমুনার ঘরে যান এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন যে, যে ভাই এই দিনে যমুনা জলে স্নান করবে, তার অকাল মৃত্যু হবে না।
এ থেকে এও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যমুনা জলের সম্পর্ক মৃত্যু ও যমলোকের সঙ্গে। এই কারণে এটিকে ঘরে রাখতে নিষেধ করা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, ঘরে যমুনা জল রাখলে ঘরের পরিবেশ স্থির থাকে না এবং এই জল নেতিবাচক শক্তিকে আকর্ষণ করে।
গঙ্গাজল ও যমুনা জলে পার্থক্য
যেখানে গঙ্গাজলকে অমৃতের সমান মানা হয়, সেখানে যমুনা জলকে কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। গঙ্গাজল ঘরে রাখলে ইতিবাচক শক্তির প্রবাহ বাড়ে, যেখানে যমুনা জল ঘরে রাখলে মানসিক অশান্তি, দারিদ্র্য এবং রোগের যোগ তৈরি হতে পারে।
শাস্ত্রে গঙ্গাকে মোক্ষদায়িনী বলা হয়েছে এবং যমুনাকে পাপ নাশকারী, কিন্তু দুজনের প্রকৃতি আলাদা মানা হয়েছে। গঙ্গাজলকে যেখানে দিনচর্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানে যমুনা জলকে কর্মকাÐ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
গরুড় পুরাণ ও পদ্ম পুরাণে উল্লেখ
গরুড় পুরাণে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, যমুনার জল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এর ব্যবহার কেবল তীর্থস্নান বা প্রায়শ্চিত্ত কর্মের সময়েই করা উচিত। একইভাবে পদ্মপুরাণেও এই উল্লেখ আছে যে, যমুনা জলকে ঘরে রাখলে যমলোকের শক্তি আকৃষ্ট হয়, যার ফলে ঘরের পরিবেশ প্রভাবিত হতে পারে।
এই জলকে কেবল তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্যই উপযুক্ত বলা হয়েছে। এটিকে ঘরে দীর্ঘ সময় ধরে রাখা শুভ মানা হয় না। প্রাচীন ঋষিরা ও বিদ্বানরাও এটি স্পষ্ট করেছেন যে, যমুনা জলের শক্তি অত্যন্ত তেজীয় হয়, যা ঘরের সাধারণ শক্তি ব্যবস্থাকে বিগড়ে দিতে পারে।
বাস্তুশাস্ত্রেও যমুনা জল বর্জিত
বাস্তুশাস্ত্রে যমুনা জলকে ঘরে রাখার জন্য অনুপযুক্ত বলা হয়েছে। বাস্তু অনুসারে, যমুনা জল কৃষ্ণবর্ণ, অস্থিরতা ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর থেকে ঘরে মানসিক চাপ, অস্থিরতা ও দারিদ্র্য বাড়তে পারে।
এর বিপরীতে গঙ্গাজলকে শুদ্ধি ও ভারসাম্যের প্রতীক মানা হয়েছে। বাস্তুতে এও বলা হয়েছে যে, যে জিনিসগুলোর সম্পর্ক যম বা মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত, সেগুলোকে ঘরে স্থায়ীভাবে রাখা উচিত নয়। যমুনা জলও এই শ্রেণীতেই পড়ে।
লোক পরম্পরা ও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মান্যতা
গ্রামীণ ভারতে আজও এই মান্যতা প্রচলিত আছে যে, যমুনা জলকে কেবল ব্রত, পার্বণ, শ্রাদ্ধ ও তীর্থযাত্রাতেই ব্যবহার করা উচিত। সেখানকার লোকেরা যমুনা থেকে স্নান করে ফেরেন, কিন্তু জলকে ঘরে আনেন না। এমনটা মানা হয় যে, এর থেকে ঘরে কলহ, রোগ এবং আকস্মিক ঘটনা ঘটতে পারে।
কিছু স্থানে এও প্রচলন আছে যে, যমুনা জল কেবল তখনই আনা হয় যখন কোনো বিশেষ তর্পণ বা মৃত আত্মার শান্তির অনুষ্ঠান করা হয়। এতে স্পষ্ট যে, লোক পরম্পরায়ও যমুনা জলকে সহজ ব্যবহারের বস্তু মানা হয়নি।
যমুনা জলের পবিত্রতা ও শক্তি
যমুনা জল যত পবিত্র, ততটাই তার শক্তিও তীব্র মানা হয়েছে। এটাই কারণ যে, এটিকে শুধু সীমিত সময়ের জন্য ও বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। এই জল পাপের নাশ তো করে, কিন্তু এর শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে মানা হয়েছে।
ধর্মীয় গ্রন্থে লুকানো আছে রহস্য
শাস্ত্রে অনেকবার এই কথাটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যমুনা জলের প্রয়োগ শুধু তীর্থকর্ম, স্নান ও শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানেই করা উচিত। এর তুলনা গঙ্গা জলের সঙ্গে করা যেতে পারে না, কারণ দুজনের ধর্মীয় উপযোগিতা ভিন্ন।