প্রতি বছর ১১ জুলাই সারা বিশ্বে 'ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ডে' অর্থাৎ 'বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস' পালন করা হয়। এই দিনের উদ্দেশ্য হল ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং বোঝানো যে সময় থাকতে যদি এর নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি মানবজাতির জন্য গুরুতর সংকট ডেকে আনতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীতে ৮ বিলিয়নের বেশি মানুষ বাস করছে এবং এই সংখ্যা প্রতি বছর প্রায় ৮.৩ কোটির বেশি হারে বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে – এত বিশাল জনসংখ্যার জন্য আমাদের কাছে কি পর্যাপ্ত সম্পদ আছে?
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ডে-র ইতিহাস
এই দিনটির সূচনা হয় ১৯৮৯ সালে, ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (UNDP)-এর হাত ধরে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এর অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় 'ফাইভ বিলিয়ন ডে' থেকে, যা ১১ জুলাই ১৯৮৭ তারিখে পালিত হয়েছিল, যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রথমবার ৫ বিলিয়ন অতিক্রম করে। সেই থেকে প্রতি বছর এই দিনটি বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়, যাতে জনসংখ্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলো, যেমন পরিবার পরিকল্পনা, নারী ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা, ইত্যাদির ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যায়।
কেন জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বিপজ্জনক?
১. প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ
পৃথিবীর সম্পদ সীমিত – তা জল হোক, খাদ্য হোক, বিদ্যুৎ হোক বা শক্তি। জনসংখ্যা যত দ্রুত বাড়ছে, সেই হারে এই সম্পদগুলির ব্যবহারও বাড়ছে। যদি এই ধারা চলতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে খাবার জল এবং খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে।
২. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রভাবিত
বেশি জনসংখ্যার সরাসরি প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবার উপর। সরকারি স্কুল ও হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ে এবং সম্পদের অভাব দেখা দেয়। এর ফলে গুণগত মানের অবনতি হয় এবং দরিদ্র শ্রেণী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. বেকারত্ব ও দারিদ্র্য
জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় প্রভাব কর্মসংস্থানের সুযোগের উপরও পড়ে। যখন মানুষ বেশি হবে এবং চাকরি কম, তখন বেকারত্ব বাড়বে। বেকারত্ব থেকে দারিদ্র্য, অপরাধ এবং সামাজিক বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলো জন্ম নেবে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনকে উৎসাহিত করে
যত বেশি মানুষ হবে, তত বেশি দূষণ হবে। বেশি গাড়ি, বেশি কলকারখানা, বেশি শক্তি খরচ – এই সব একসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য
- ২০০০ সালে গড় আয়ু ছিল ৬৭ বছর, যা ২০১৫ সালে ৭১ বছর এবং ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৭৭ বছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- ১৯৬০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক প্রজনন হার (Fertility Rate) হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু জনসংখ্যা এখনও বাড়ছে কারণ মৃত্যুর হার কমে গেছে।
- প্রতিদিন প্রায় ২ লক্ষের বেশি শিশু জন্ম নেয়, যেখানে মৃতের সংখ্যা তার থেকে অনেক কম।
পরিবার পরিকল্পনা: সমাধানের প্রথম ধাপ
পরিবার পরিকল্পনা, অর্থাৎ ফ্যামিলি প্ল্যানিং, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। যদি প্রতিটি পরিবার দায়িত্বের সঙ্গে তাদের সন্তানের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ঠিক করে, তাহলে দেশ এবং সমাজ উভয়েরই উপকার হবে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রকল্প ও সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে, কিন্তু আসল দায়িত্ব সমাজের। পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই এই দিকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা উচিত।
কীভাবে পালন করবেন বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস?
- সচেতনতা তৈরি করুন: সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্য শেয়ার করুন। #WorldPopulationDay হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করুন।
- স্থানীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন: স্কুল, কলেজ এবং এনজিওগুলির দ্বারা আয়োজিত সেমিনার, কর্মশালায় অংশ নিন।
- স্বেচ্ছাসেবী হন: এমন সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত হন যারা পরিবার পরিকল্পনা ও নারী ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে।
- নিজের পরিবার থেকে শুরু করুন: নিজে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করুন এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করুন।
শিশুদেরও শেখান জনসংখ্যার গুরুত্ব
আজকের প্রজন্মই ভবিষ্যতের দায়িত্বশীল নাগরিক হবে। তাই শিশুদের শুরু থেকেই জনসংখ্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি। তাদের বোঝাতে হবে যে অতিরিক্ত জনসংখ্যার অর্থ কেবল বেশি মানুষ নয়, বরং কম সম্পদ এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যাও বটে।
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা কেবল সংখ্যা নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যতের উপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হতে হবে। সময় থাকতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নারী ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলির দিকে মনোযোগ দেওয়া আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সচেতনতাই সমাধানের প্রথম ধাপ। আসুন, সকলে মিলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও নিরাপদ ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করি।