চীন রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট (Rare Earth Magnets) নিয়ে এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছে যা বিশ্বজুড়ে শিল্পপতি এবং কৌশলবিদদের হতবাক করে দিয়েছে। জুন মাসে চীন হঠাৎ করেই এই ম্যাগনেটগুলির রপ্তানি দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মে মাসে যেখানে চীন ১,২৩৮ টন রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট রপ্তানি করেছিল, সেখানে জুনে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,১৮৮ টন। এই বিশাল বৃদ্ধিতে পুরো গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন (Global Supply Chain) আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
আমেরিকা সবচেয়ে বেশি লাভবান
এই রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আমেরিকা। মে মাসে চীন আমেরিকাতে মাত্র ৪৬ টন রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট পাঠিয়েছিল, যেখানে জুনে এই সংখ্যা সরাসরি বেড়ে ৩৫৩ টনে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, আমেরিকা এক মাসে প্রায় সাত গুণ বেশি সাপ্লাই পেয়েছে। এই পরিবর্তন এমন এক সময়ে হয়েছে যখন চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা আবারও বাড়ছে এবং রেয়ার আর্থ মেটালস (Rare Earth Metals) নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এটা কি চীনের কৌশলগত চাল?
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চীনের এই পদক্ষেপ শুধু একটি বাণিজ্যিক স্বস্তি নয়, বরং একটি কৌশলগত চালও হতে পারে। এপ্রিল ২০২৫-এর শুরুতে চীন ১৭টি রেয়ার আর্থ এলিমেন্টের (Rare Earth Elements) মধ্যে ৭টির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এই ধাতুগুলি ইলেকট্রিক ভেহিকেল (Electric Vehicles), ফাইটার জেট (Fighter Jets), মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, উইন্ড টারবাইন (Wind Turbine) এবং এমনকি মিসাইল সিস্টেমেও (Missile System) ব্যবহার করা হয়।
সেই সময় বিশ্বজুড়ে কোম্পানিগুলিকে তাদের প্ল্যান্ট বন্ধ করার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। বিশেষ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যেখানে এই ম্যাগনেটগুলির প্রচুর ব্যবহার হয়, তারা সরাসরি সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছিল। এমন পরিস্থিতিতে জুনে হঠাৎ করে রপ্তানি বাড়ানোকে কেবল কাকতালীয় ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে না।
জেনেভা বৈঠকের পর বাড়ল এক্সপোর্ট
জুন মাসে জেনেভাতে আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছিল। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক উত্তেজনা কমানো এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ পুনরুদ্ধার করা। এই বৈঠকের কয়েক দিন পরেই চীন রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটের এক্সপোর্ট দ্রুত বাড়িয়ে দেয়।
এই বৈঠকের পর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে চীন রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটের সাপ্লাই পুরো করতে রাজি হয়েছে। তিনি এটিকে বাণিজ্যিক যুদ্ধবিরতির দিকে একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করেছিলেন।
কেন জরুরি রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটস
রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে থাকা উপাদানগুলোর বিশেষত্ব হল, এগুলো খুব ছোট আকারেও অসাধারণ চৌম্বকীয় শক্তি তৈরি করতে পারে।
এগুলো বিশেষ করে ইলেকট্রিক ভেহিকেলের মোটর, মোবাইল ফোনের স্পিকার, উইন্ড টারবাইনের জেনারেটর, সোলার প্যানেল এবং ডিফেন্স ইকুইপমেন্টে (Defence Equipment) ব্যবহার করা হয়। চীন এই ম্যাগনেটগুলির সবচেয়ে বড় উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক দেশ এবং বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট চীন থেকেই আসে।
নিষেধাজ্ঞার পর তৈরি হয়েছিল অস্থিরতা
এপ্রিলের শুরুতে যখন চীন ৭টি রেয়ার আর্থ উপাদানের রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তখন বিশ্ব বাজারে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। আমেরিকা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (European Union) মতো বড় দেশগুলো তাদের ফ্যাক্টরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল না পাওয়ার চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে আমেরিকান ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির (American Defence Industry) জন্য এটা একটা বড় ধাক্কা ছিল।
চীনের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ওপর গ্লোবাল নির্ভরতা
রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটের ক্ষেত্রে চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির ওপর বিশ্বের অনেক বেশি নির্ভরতা রয়েছে। আইফোন (iPhone) তৈরি হোক বা ব্যাটেল ট্যাঙ্ক (Battle Tank), এই সব কিছুতেই এই উপাদানগুলোর প্রয়োজন পড়ে। চীন এই সেক্টরে কয়েক দশক আগে থেকে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে এবং এখন তারা এর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।
অন্য দেশগুলোও প্রস্তুতি নিচ্ছে
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপীয় দেশগুলো এখন নিজেদের রেয়ার আর্থ সাপ্লাই চেইন তৈরি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া ধীর গতির এবং ব্যয়বহুল।
কিছু দেশ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকাতে রেয়ার আর্থ মেটালের খনিগুলোতে বিনিয়োগ করছে, কিন্তু এখান থেকে সাপ্লাই স্থিতিশীল হতে এখনও কয়েক বছর লাগতে পারে।
চীনের চালগুলোর ওপর বাড়ছে নজর
এখন যখন চীন আবার এক্সপোর্ট বাড়িয়েছে, তখন বিশ্বজুড়ে কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা এটা বোঝার চেষ্টা করছেন যে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। এটা কি স্থায়ী স্বস্তি, নাকি শুধু সাময়িক কোনো কৌশল?
একটা বিষয় স্পষ্ট যে চীন রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটকে শুধু বাণিজ্যিক সম্পদ হিসেবে নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আর এটাই বিষয়টিকে আরও বড় করে তুলছে।
রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট গ্লোবাল পাওয়ার গেমের অংশ
এখন রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট শুধু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পোনেন্ট (Industrial Component) নয়। এটা আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি এবং নিরাপত্তা নীতির অংশ হয়ে উঠেছে। আর চীন এই গেমে আপাতত সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে।