যখনই আমরা কম্পিউটারের মাউস ব্যবহার করি, খুব কমই ভাবি যে এর পিছনে একটি মহান মস্তিষ্ক ছিল যিনি এই ছোট যন্ত্রটির মাধ্যমে বিশ্বের প্রযুক্তিগত দৃশ্যপট পরিবর্তন করে দিয়েছেন। সেই ব্যক্তি আর কেউ নন, ডগলাস কার্ল এঙ্গেলবার্ট – একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক এবং দূরদর্শী, যাঁর চিন্তা ভাবনা সময়ের থেকে কয়েক দশক এগিয়ে ছিল। তিনি শুধু প্রযুক্তি তৈরি করেননি, বরং মানুষের বুদ্ধি এবং মেশিনের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন।
প্রাথমিক জীবন: এক সাধারণ বালক থেকে অসাধারণ বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার যাত্রা
ডগলাস কার্ল এঙ্গেলবার্টের জন্ম ১৯২৫ সালের ৩০শে জানুয়ারি আমেরিকার ওরেগন রাজ্যের পোর্টল্যান্ড শহরে। তিনি ছিলেন তিন সন্তানের মধ্যে মেজো। যখন তাঁর বয়স আট বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান এবং তাঁদের পরিবার গ্রাম্য এলাকায় চলে যায়। নানান অসুবিধা ও সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও, ডগলাসের মনোযোগ পড়াশোনা এবং নতুন জিনিস জানার দিকে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, তিনি আমেরিকান নৌবাহিনীতে রেডিও এবং রাডার টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন। সেখানেই, ফিলিপিন্সের একটি ছোট দ্বীপ লেটে-তে, তিনি ভ্যানেভার বুশের বিখ্যাত প্রবন্ধ 'As We May Think' পড়েন। এই প্রবন্ধটি তাঁর মনে প্রযুক্তি এবং মানব বুদ্ধির সংমিশ্রণ নিয়ে একটি আগ্রহ তৈরি করে, যা তাঁর জীবনের পথ নির্ধারণ করে দেয়।
শিক্ষা এবং প্রাথমিক কর্মজীবন: এক স্বপ্নদ্রষ্টার নির্মাণ
১৯৪৮ সালে তিনি ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর পরে, তিনি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময়কালে তিনি কম্পিউটার, ডেটা স্টোরেজ এবং সার্কিট ডিজাইন-এর মতো ক্ষেত্রগুলিতে গভীর গবেষণা করেন। বার্কলেতে থাকাকালীন তিনি CALDIC কম্পিউটারের বিকাশে অংশ নিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকটি পেটেন্টও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ছিল না শুধু কম্পিউটার তৈরি করা, বরং মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে 'অগমেন্ট' করা – অর্থাৎ বৃদ্ধি করা।
উদ্ভাবনের আঁতুড়ঘর: SRI এবং অগমেন্টেশন রিসার্চ সেন্টার
১৯৫৭ সালে ডগলাস SRI ইন্টারন্যাশনাল (তৎকালীন স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট)-এ যোগদান করেন। এখানেই তিনি 'অগমেন্টটিং হিউম্যান ইন্টেলেক্ট: এ কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক' নামক একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেন, যেখানে তিনি কম্পিউটার এবং মানব মস্তিষ্কের সহযোগিতাকে সংজ্ঞায়িত করেন। তাঁর নেতৃত্বে অগমেন্টেশন রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে তিনি এমন একটি দল তৈরি করেন যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিল। এই ল্যাবরেটরিতে কম্পিউটার মাউস, বিটম্যাপ স্ক্রিন, ওয়ার্ড প্রসেসিং, হাইপারটেক্সট এবং গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস-এর মতো আজকের দিনের সর্বত্র ব্যবহৃত প্রযুক্তিগত আবিষ্কারগুলির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
বিপ্লবের শুরু: 'দ্য মাদার অফ অল ডেমোস' – একটি ঐতিহাসিক প্রদর্শন
১৯৬৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর এঙ্গেলবার্ট বিশ্বের সামনে তাঁর কাজের একটি প্রদর্শনী করেন, যা 'The Mother of All Demos' নামে পরিচিত। এই ডেমোতে তিনি কম্পিউটার মাউস, হাইপারলিঙ্ক, স্ক্রিন শেয়ারিং, রিয়েল-টাইম এডিটিং এবং ভিডিও কলিং-এর মতো প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করান – তাও সেই সময়ে যখন ইন্টারনেটের নামও হয়তো কেউ শোনেনি। এই উপস্থাপনাটি কেবল প্রযুক্তিগতভাবে চিত্তাকর্ষক ছিল না, বরং এটি ছিল আগামী দিনের ডিজিটাল জীবনের একটি ঝলক। এটা বললে ভুল হবে না যে এই একটি ডেমো পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
মাউস: একটি ছোট যন্ত্র, একটি বড় বিপ্লব
এঙ্গেলবার্ট তাঁর সহকারী বিল ইংলিশের সাথে মিলিত হয়ে কম্পিউটার মাউসের প্রথম প্রোটোটাইপ তৈরি করেন। এটি ছিল কাঠের একটি বাক্স যাতে দুটি ধাতব চাকা লাগানো ছিল। তিনি ১৯৬৭ সালে এর জন্য পেটেন্টের আবেদন করেন এবং ১৯৭০ সালে পেটেন্ট পান। মজার বিষয় হল, এঙ্গেলবার্ট কখনও মাউসের জন্য রয়্যালটি নেননি। এসআরআই এই পেটেন্টটি মাত্র $৪০,০০০-এর বিনিময়ে অ্যাপেলকে লাইসেন্স দেয়। তা সত্ত্বেও, এঙ্গেলবার্টের চিন্তা কোনো ব্যক্তিগত লাভের ঊর্ধ্বে ছিল – তিনি শুধুমাত্র মানবতার সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তাকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন।
সংগ্রাম এবং প্রান্তিকীকরণ: যখন বিশ্ব প্রস্তুত ছিল না
১৯৭০-এর দশকে, যখন পার্সোনাল কম্পিউটিং-এর যুগ শুরু হতে লাগল, তখন ডগলাসের কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্ক ভিত্তিক চিন্তা মূলধারা থেকে সরে যেতে শুরু করে। অনেক সহযোগী জেরক্স পিএআরসি-তে চলে যান এবং ডগলাস ধীরে ধীরে প্রযুক্তি জগৎ থেকে দূরে সরে যান। TimeShare এবং তারপর McDonnell Douglas-এ থাকাকালীন, তিনি তাঁর গবেষণায় বেশি সমর্থন পাননি। এক সময় এমনও আসে যখন তাঁর ল্যাবরেটরি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাঁকে সংস্থার উপদেষ্টা পদে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ডগলাস কখনও থামেননি। তিনি তাঁর মেয়ে ক্রিস্টিনার সাথে মিলিত হয়ে "বুটস্ট্র্যাপ ইনস্টিটিউট" প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ডগ এঙ্গেলবার্ট ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত হয়।
আদর্শ ও দর্শন: সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তার যুগ
এঙ্গেলবার্ট বিশ্বাস করতেন যে প্রযুক্তি শুধুমাত্র উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যম নয়, বরং মানুষের চেতনাকে প্রসারিত করার উপায়ও হতে পারে। তিনি 'কালেক্টিভ আইকিউ'-এর তত্ত্ব দেন – অর্থাৎ সমাজ হিসেবে আমরা কীভাবে আরও বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে ভাষা আমাদের চিন্তাভাবনার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে, তেমনই প্রযুক্তিগত উপায় আমাদের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই, যদি আমাদের সমাজ হিসেবে উন্নত হতে হয়, তবে আমাদের সরঞ্জামগুলিকে আরও উন্নত করতে হবে।
সম্মান এবং শেষ জীবনের কৃতিত্ব
ডগলাস এঙ্গেলবার্ট তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলোতে তাঁর অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০০ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন তাঁকে ন্যাশনাল মেডেল অফ টেকনোলজি-তে ভূষিত করেন। তিনি ট্যুরিং অ্যাওয়ার্ড, লেমেলসন-এমআইটি পুরস্কার, ফ্র্যাঙ্কলিন মেডেল এবং অন্যান্য অনেক আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেন। ২০০৫ সালে তিনি কম্পিউটার ইতিহাস জাদুঘরের ফেলো হন। তিনি ওপেন-সোর্স প্রজেক্ট হাইপারস্কোপের মাধ্যমে তাঁর পুরনো সিস্টেম 'অগমেন্ট'-কে আধুনিক রূপ দেওয়ার কাজও করেন। ২ জুলাই ২০১৩ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে তিনি মারা যান। তাঁর বয়স ছিল ৮৮ বছর এবং তিনি আলঝেইমার রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রযুক্তিগত উত্তরাধিকার আজও জীবন্ত।
ডগলাস এঙ্গেলবার্টের জীবন সেই সত্যকে তুলে ধরে যে দূরদর্শী চিন্তা রাখেন যাঁরা, তাঁদের প্রায়শই তাৎক্ষণিক সমাজ বুঝতে পারে না, কিন্তু তাঁদের কাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকনির্দেশ করে। কম্পিউটার মাউস থেকে শুরু করে সহযোগী ডিজিটাল সরঞ্জাম পর্যন্ত, তাঁর ধারণাগুলি কেবল প্রযুক্তিকে আকার দেয়নি, বরং আমাদের চিন্তা করার, যোগাযোগ করার এবং সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিকেও পরিবর্তন করে দিয়েছে।