হাঁটুতে ব্যথা এখন আর কেবল বৃদ্ধদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ৩০ বছর বয়স পেরোতেই তরুণদেরও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চলাফেরা করতে অসুবিধা, উঠতে-বসতে কষ্ট এবং সকালে ঘুম থেকে উঠেই stiffness—এগুলো সবই ইঙ্গিত করে যে আপনার হাঁটু সাহায্য চাইছে। আধুনিক জীবনযাত্রা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কাজ করা এবং খাদ্যের প্রতি অমনোযোগিতার কারণে এই সমস্যাটি বাড়ছে।
তরুণদের মধ্যে হাঁটু সমস্যার উদ্বেগজনক প্রবণতা
আগে যেখানে ৫০ বছর বয়সের পর হাঁটুতে ব্যথা একটি সাধারণ বিষয় ছিল, সেখানে এখন ৩০-৩৫ বছর বয়সেই অনেকে এই সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসক এবং অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদে জীবনের গুণমানকে প্রভাবিত করে। সময় মতো হাঁটুর যত্ন না নিলে এই সমস্যা স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
প্রধান কারণ: কম বয়সে হাঁটুতে ব্যথার কারণ কী?
১. দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা এবং ভুল ভঙ্গি
অফিস অথবা অনলাইন কাজ করা লোকেরা সাধারণত ৮-১০ ঘণ্টা চেয়ারে বসে কাটান। একটানা একই ভঙ্গিতে বসে থাকা এবং চেয়ার-টেবিলের উচ্চতা সঠিক না হওয়ার কারণে হাঁটু এবং কোমর—উভয়ের উপরই প্রভাব পড়ে। হাঁটুর সংযোগস্থলে চাপ বাড়ে এবং ব্যথা শুরু হয়।
২. অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা
বাড়তি ওজন শরীরের প্রতিটি সংযোগস্থলে প্রভাব ফেলে, তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে হাঁটুতে। শরীরের পুরো ভার হাঁটুকেই বহন করতে হয়, যার ফলে তরুণাস্থি ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে এবং অস্টিওআর্থারাইটিস-এর মতো রোগ হয়।
৩. পুষ্টির অভাব
আজকের ফাস্ট ফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টির মারাত্মক অভাব থাকে। ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, এবং প্রোটিনের মতো পুষ্টি উপাদান হাড় ও সংযোগস্থলের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এগুলির অভাবে হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং হাঁটুতে ব্যথা শুরু হয়।
৪. ব্যায়ামের অভাব বা ভুল ব্যায়াম
সুস্থ থাকার আকাঙ্ক্ষায় অনেকেই হঠাৎ করে ভারী ওয়ার্কআউট শুরু করেন অথবা কোনো প্রশিক্ষক ছাড়াই ভুল ব্যায়াম করেন। এর ফলে হাঁটুতে অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়ে। আবার, একেবারেই ব্যায়াম না করা পেশী দুর্বল করে এবং সংযোগস্থলে প্রভাব ফেলে।
৫. ভুল জুতো ব্যবহার
হাই হিল, শক্ত তলার জুতো বা খুব টাইট জুতো পরলে শরীরের ভঙ্গি পরিবর্তিত হয় এবং হাঁটুতে ভারসাম্যহীন চাপ পড়ে। এর ফলে ব্যথা এবং ফোলাভাবের মতো সমস্যা হতে পারে।
৩০ বছর বয়সে হাঁটু সুস্থ রাখার সহজ উপায়
১. সঠিক ভঙ্গিতে বসুন এবং উঠুন: অফিসে কাজ করার সময় ergonomic চেয়ার ব্যবহার করুন। প্রতি ৩০ মিনিটে কিছুক্ষণ উঠে হাঁটাহাঁটি করুন। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসার অভ্যাস করুন।
২. ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা হাঁটুতে সবচেয়ে কম চাপ ফেলে। স্বাস্থ্যকর খাবার এবং নিয়মিত যোগা বা হাঁটার মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
৩. সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন: দুধ, দই, পনির, বাদাম, ডুমুর, সবুজ শাকসবজি, ডিম, এবং সূর্যের আলো থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন ডি—এগুলি হাড়কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
৪. যোগা এবং স্ট্রেচিং করুন: বজ্রাসন, তাদাসন, অর্ধচক্রাসন-এর মতো যোগা হাঁটুতে উপকার করে। সকালে ১৫ মিনিট স্ট্রেচিং করুন, যাতে পেশী নমনীয় থাকে।
৫. সঠিক জুতো পরুন: আরামদায়ক, সাপোর্ট যুক্ত এবং ফ্ল্যাট সোল যুক্ত জুতো পরুন। হিল জুতো বিশেষ অনুষ্ঠানে সীমিত রাখুন।
বাড়ির কিছু টোটকাও কার্যকরী
- হলুদ এবং দুধ: হলুদে উপস্থিত কারকুমিন প্রদাহ এবং ব্যথা কমায়। রোজ রাতে এক গ্লাস হলুদ দুধ পান করা উপকারী।
- জোয়ানের ব্যবহার: জোয়ানের জল সংযোগস্থলের ফোলাভাব কমায় এবং হজম ক্ষমতাও উন্নত করে।
- সর্ষের তেল দিয়ে মালিশ: হালকা গরম সর্ষের তেল দিয়ে হাঁটু মালিশ করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং ব্যথা থেকে আরাম পাওয়া যায়।
৩০ বছর বয়সে হাঁটুতে সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক নয়, এটি ইঙ্গিত দেয় যে আপনার শরীরের যত্নের প্রয়োজন। জীবনযাত্রায় ছোট ছোট পরিবর্তন এনে এবং সময় মতো সতর্কতা অবলম্বন করে আপনি এই সমস্যা থেকে বাঁচতে পারেন। হাঁটুর যত্ন নিন, কারণ হাঁটাচলা তখনই সম্ভব যখন আপনার হাঁটু সুস্থ থাকবে।