আমেরিকার শুল্ক আরোপ: ভারতীয় অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

আমেরিকার শুল্ক আরোপ: ভারতীয় অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

৩১শে জুলাই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি অপ্রত্যাশিত ঘোষণা করেন, যেখানে তিনি ভারত থেকে আসা সমস্ত পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলেন। এই সিদ্ধান্তটি এমন সময়ে এসেছে যখন ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। এতে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ফার্মা ও জুয়েলারি সেক্টরে বেশি প্রভাব

ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল এবং রত্ন-অলঙ্কার (জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি) সেক্টর আমেরিকার উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। এই সেক্টরগুলির জন্য আমেরিকা সবচেয়ে বড় বাজার। শুল্ক বাড়লে এই পণ্যগুলির দাম আমেরিকাতে বাড়বে, যার ফলে তাদের চাহিদা কমতে পারে। এতে এই ক্ষেত্রগুলোতে কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং বিনিয়োগের উপর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আইটি সেক্টরে পরোক্ষ ধাক্কা

আইটি শিল্পের উপর এই শুল্কের সরাসরি প্রভাব না পড়লেও, এর একটি পরোক্ষ প্রভাব অবশ্যই দেখা যেতে পারে। EY ইন্ডিয়ার টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ নীতিন ভট্টের মতে, শুল্কের কারণে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর খরচ বাড়বে, যার ফলে তারা তাদের খরচ কমাতে পারে। প্রযুক্তিগত পরিষেবা এবং আউটসোর্সিংয়ের উপর প্রথম প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় আইটি কোম্পানিগুলো নতুন প্রোজেক্ট পেতে দেরি হতে পারে বা কন্ট্রাক্ট রিনিউয়ালের গতি কমে যেতে পারে।

টেক্সটাইল শিল্পের উপরও প্রভাব

বস্ত্র শিল্প ভারতের একটি বড় রপ্তানি ক্ষেত্র। আমেরিকাতে এর ভালো চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার পরে ভারতীয় বস্ত্রের দাম বাড়বে এবং আমেরিকান ক্রেতারা ভিয়েতনাম, বাংলাদেশের মতো সস্তা বিকল্পের দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যারা এই ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল।

জিডিপি বৃদ্ধিতে কতটা প্রভাব

ব্রিটিশ ব্যাংক বার্কলেজের রিপোর্ট অনুসারে, এই শুল্কের প্রভাব ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)-এর উপর পড়তে পারে। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এর ফলে ভারতের বিকাশের হার ০.৩০ শতাংশ পর্যন্ত কম হতে পারে। যদিও ভারতের অর্থনীতি মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদার উপর নির্ভরশীল, তাই এর ব্যাপক প্রভাব সীমিত হতে পারে।

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ বেড়েছে

ভারত সবসময়ই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং স্থিতিশীল বাজার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু আমেরিকার শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত এবং ভারত-রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে তৈরি হওয়া ধোঁয়াশার কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হয়ে গেছেন। শেয়ার বাজারেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আমেরিকাতে থাকা বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে হওয়া আমদানির উপর শুল্কের কারণে দাম বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের পরিকল্পনা প্রভাবিত হতে পারে।

ভারত-রাশিয়ার বাণিজ্যের উপর আমেরিকার নজর

ট্রাম্পের বিবৃতিতে শুধু শুল্ক নয়, ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের বিষয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। আমেরিকা চায় ভারত রাশিয়া থেকে তেল এবং সামরিক সরঞ্জাম কেনা সীমিত করুক। কিন্তু ভারতের জন্য রাশিয়া শক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই কারণে ভারতের উপর দ্বিমুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনা, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতার চাপ।

আসন্ন বাণিজ্য আলোচনায় সংকট

আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ২৫শে আগস্ট ভারতে আসার কথা। এই সময় উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ট্রাম্পের এই ঘোষণা আগেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে দিয়েছে। আমেরিকার পক্ষ থেকে এর আগেও কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের উপর কিছু শর্ত রাখা হয়েছে, যা ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে এখন আলোচনার ইতিবাচক ফলাফল আসার সম্ভাবনা কম।

বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের কৌশল গুরুত্বপূর্ণ হবে

ভারতের ভূমিকা এখন আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো দুটি শক্তিশালী দেশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে তাকে রাশিয়া থেকে শক্তি এবং সামরিক চাহিদা পূরণ করতে হবে, অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলোতে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে নীতিগত স্তরে খুব সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে বাণিজ্য ঘাটতি না বাড়ে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

গ্রামীণ এলাকা ও কৃষকদের উপরও প্রভাব

ভারত থেকে আমেরিকাতে পাঠানো কিছু কৃষি পণ্য, যেমন চাল, মশলা, ফল ইত্যাদিও শুল্কের আওতায় আসতে পারে। এতে দেশের গ্রামীণ এলাকা এবং কৃষকদের আয়ের উপরও প্রভাব পড়তে পারে। এই ক্ষেত্রগুলোতে আগে থেকেই মূল্যবৃদ্ধি এবং বর্ষাকাল সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিতে বাধা নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।

Leave a comment