ভারত সরকার ২৪ জুলাই থেকে পুনরায় চীনা নাগরিকদের জন্য ট্যুরিস্ট ভিসা সুবিধা পুনরুদ্ধার করেছে। এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এসেছে যখন দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সম্পর্কের অবনতি চলছিল। গালওয়ান উপত্যকার ঘটনার পর থেকে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছিল। এখন ভিসা পুনরুদ্ধারের এই পদক্ষেপকে দুই দেশের মধ্যে আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র পর্যটন নয়, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তির পথও খুলে দিতে পারে।
বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আগে থেকেই গভীর। চীন থেকে ভারত চিকিৎসা সরঞ্জাম, মোবাইল ফোন, সস্তা ইলেকট্রনিক্স এবং প্রয়োজনীয় শিল্প কাঁচামাল পায়। মেশিন থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে চীনের উপর নির্ভরতা দেখা যায়। চীনের সাথে ব্যবসা স্বাভাবিক হওয়ার মানে হল, ভারতীয় বাজারে খরচ কমবে এবং সাপ্লাই চেইনে স্থিতিশীলতা আসবে।
অন্যদিকে, ভারতের ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য এটি আরও বেশি জরুরি যে তারা চীন থেকে সস্তা এবং ভাল কাঁচামাল পেতে পারে। ট্যুরিস্ট ভিসা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে যে ভারত এই সম্পর্ককে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায়।
মার্কিন নীতির কারণে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতিতে ভারতকে নিয়ে কিছুটা অনিশ্চিত মনোভাব দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তানকে আবারও গুরুত্ব দেওয়া এবং পাক সেনা প্রধানকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ভারতের নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হচ্ছে যে শুধু আমেরিকার উপর ভরসা করা কতটা সঠিক হবে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারত তার পররাষ্ট্র নীতিকে বহুপাক্ষিক ভারসাম্যের দিকে মোড় দিতে শুরু করেছে। এতে চীনের সাথে সংলাপ এবং সহযোগিতা কৌশলগত বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সীমান্ত বিরোধ সত্ত্বেও সম্পর্কে নরম সুর
সীমান্তে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় থাকলেও, উভয় দেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিচক্ষণতা দেখিয়েছে। আলোচনা এবং সামরিক পর্যায়ে যোগাযোগ বজায় রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখন ভিসার মতো পদক্ষেপগুলো দেখাচ্ছে যে ভারত সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী, তবে সম্পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করে।
সীমান্তে উত্তেজনা কমলে শুধু প্রতিরক্ষা বাজেটের ওপর চাপ কমবে না, উভয় দেশ তাদের শক্তি অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় নিয়োজিত করতে পারবে।
বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য পথ খুলবে
নীতি আয়োগের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাবও এসেছে যে, চীনের কোম্পানিগুলো ভারতীয় কোম্পানিতে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ কোনো সরকারি অনুমতি ছাড়াই করতে পারবে। এতে দীর্ঘ দিন ধরে আটকে থাকা চুক্তিগুলো দ্রুত সম্পন্ন হতে পারে এবং বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নতি হতে পারে।
অনেক চীনা কোম্পানি আগে থেকেই ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং এবং প্রযুক্তি খাতে আগ্রহী। যদি সম্পর্কের উন্নতি হয়, তাহলে এই কোম্পানিগুলো আবার সক্রিয় হতে পারে এবং এর ফলে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগও তৈরি হতে পারে।
পর্যটন এবং শিক্ষায়ও খুলবে নতুন সুযোগ
ট্যুরিস্ট ভিসা পুনরায় চালু হওয়ার ফলে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে চলাচল বাড়বে। এতে শুধু পর্যটন বাড়বে না, ছাত্র ও গবেষকরাও একে অপরের দেশে গিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে পারবেন। ভারত ও চীন উভয়ই শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, এবং এমন পরিস্থিতিতে পারস্পরিক সহযোগিতা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
অনেক ভারতীয় ছাত্র চীনে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায়। অন্যদিকে, কিছু চীনা শিক্ষার্থীও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত। এই গমনাগমনের ফলে বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব আরও গভীর হতে পারে।
রাশিয়ার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ
রাশিয়ার পক্ষ থেকেও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ভারত ও চীনের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাশিয়া চায় এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকুক এবং আমেরিকার একতরফা ভূমিকা কমে যাক। ভারতও বুঝতে পারছে যে, যদি তাকে বিশ্ব মঞ্চে স্বাধীন ভূমিকা নিতে হয়, তাহলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন না করে বরং ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
চীনের কৌশলকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে মোকাবিলা করছে ভারত
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি এখন আরও বেশি পরিপক্ক দেখাচ্ছে। এটি কেবল অনুভূতির উপর ভিত্তি করে নয়, বরং একটি কঠিন কৌশলগত চিন্তাভাবনার অংশ। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও কৌশলগত বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীন যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে, তাহলে তাকে দুই দিক থেকে লড়তে হবে - আমেরিকা ও ভারত উভয় দিক থেকে।
অন্যদিকে, ভারতের জন্য চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা এমন একটি উপায় হতে পারে, যার মাধ্যমে সে আমেরিকার উপর অধিক নির্ভরশীল না হয়ে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারবে।
ভারতের নতুন বিদেশনীতির ইঙ্গিত
ভারতের বর্তমান বিদেশনীতি এখন শুধু একটি দেশের উপর নির্ভর করতে চায় না। আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন—এই তিনটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে ভারত এখন এমন একটি অবস্থানে পৌঁছতে চায়, যেখানে সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবে। চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসের উপর নয়, বরং প্রয়োজন ও কৌশলের ভিত্তিতে হচ্ছে।
ট্যুরিস্ট ভিসা পুনরুদ্ধার একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত যে ভারত এখন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নমনীয়তা ও বোঝাপড়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বড় সুবিধা নিয়ে আসতে পারে।