জম্মুর রঘুনাথ মন্দির ধর্মীয়, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ১৯শ শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দিরটি ভগবান রামকে উৎসর্গীকৃত এবং এটি স্থাপত্য, পান্ডুলিপি সংরক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রও বটে।
রঘুনাথ মন্দির: ভারতে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য শৃঙ্খল রয়েছে, যার মধ্যে জম্মুর রঘুনাথ মন্দির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এই মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থানই নয়, বরং ইতিহাস, শিল্প, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রও বটে। রঘুনাথ মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে ভগবান রামের এক রূপ 'রঘুনাথ'-এর নামে। এই মন্দিরটি জম্মু শহরের পুরানো অংশে, তাবি নদীর উত্তরে অবস্থিত এবং এটি ডোগরা শাসকদের সময়ে নির্মিত হয়েছিল।
ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা
রঘুনাথ মন্দিরের নির্মাণ ১৯শ শতাব্দীতে মহারাজা গোলাপ সিং শুরু করেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি ও শিলালিপি অনুসারে, এই মন্দিরটি ১৮২৭ থেকে ১৮৩৫ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল এবং এটি তাঁর পুত্র মহারাজা রণবীর সিং ১৮৬০ সালে সম্পন্ন করেন। এই মন্দিরটি তাঁদের গুরু বাবা প্রেম দাস এবং মহন্ত জগন্নাথের সম্মানে নির্মিত হয়েছিল। ডোগরা রাজাদের শাসনকালে জম্মুতে মন্দির নির্মাণের কার্যকলাপ খুব তীব্র ছিল এবং রঘুনাথ মন্দির এর সর্বোত্তম উদাহরণ।
স্থাপত্য ও কাঠামো
রঘুনাথ মন্দির সাতটি পৃথক মন্দিরের একটি চত্বর। এই মন্দিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রধানটি ভগবান রামকে উৎসর্গীকৃত। প্রতিটি মন্দিরের চূড়া সোনা দিয়ে মোড়া, যা দূর থেকে দেখতে আকর্ষণীয় লাগে। মন্দিরের প্রধান ভবনটি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর অবস্থিত এবং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ ফুট। প্রধান মন্দিরের চারপাশে ১০ ফুট চওড়া প্রদক্ষিণ পথ (প্রদক্ষিণ পথ) রয়েছে, যা ভক্তদের ভগবানকে প্রদক্ষিণ করার সুবিধা প্রদান করে।
মন্দিরের দেওয়ালে ১৫টি প্যানেলে জটিল ও সুন্দর চিত্রকর্ম করা হয়েছে। এই চিত্রগুলি রামায়ণ, মহাভারত এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার কাহিনির উপর ভিত্তি করে তৈরি। এতে ভগবান গণেশ, কৃষ্ণ এবং শেষশায়ী বিষ্ণু সহ অন্যান্য দেবদেবীর ছবিও রয়েছে। এগুলি ছাড়াও কিছু চিত্র ধর্মীয় নয় বরং সামাজিক ও ঐতিহাসিক জীবনকে চিত্রিত করে, যেমন কবীরের झलक বা ডোগরা ও শিখ সম্প্রদায়ের সৈনিক।
অভ্যন্তরীণ সজ্জা ও মূর্তি
প্রধান মন্দিরের গর্ভগৃহে ভগবান রামের মূর্তি স্থাপিত আছে। মন্দিরের অভ্যন্তর সোনা দিয়ে মোড়া এবং দেওয়ালের নিচে প্রায় ৩০০টি সুন্দরভাবে তৈরি মূর্তি রয়েছে। এই মূর্তিগুলির মধ্যে সূর্য ও শিব সহ অন্যান্য দেবতাদের প্রতিমা অন্তর্ভুক্ত। মন্দিরের চত্বরে শাস্ত্রীয় হিন্দু স্থাপত্য এবং শিখ শৈলীর ছাপ স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়।
মন্দির চত্বরে গোলাকার এবং অষ্টভুজাকার কাঠামো রয়েছে এবং এর আঙ্গিনায় প্রাচীন কালের ঘরবাড়ি ও পশুশালাও দেখা যায়। দেওয়াল এবং ছাউনিতে ফুল ও জ্যামিতিক আকারের শিল্পকর্ম মন্দিরের সজ্জাকে আরও মহিমান্বিত করে তোলে।
শিক্ষাগত ও সাহিত্যিক অবদান
রঘুনাথ মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়। মহারাজা রণবীর সিং মন্দির চত্বরে পাঠশালা ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এই গ্রন্থাগারে ৬,০০০-এর বেশি প্রাচীন পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, যার মধ্যে সংস্কৃত, দেবনাগরী এবং সারলা লিপিতে লেখা অনেক দুর্লভ বই অন্তর্ভুক্ত। এখানে বেদ, উপনিষদ, ব্যাকরণ, সঙ্গীত, নাট্যশাস্ত্র, পুরাণ এবং তন্ত্র-সাহিত্য সম্পর্কিত গ্রন্থ বিদ্যমান।
মন্দির ভাষার অনুবাদেও অবদান রেখেছে। আরবি এবং ফারসি গ্রন্থের সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এই উদ্যোগ সমসাময়িক পণ্ডিতদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। রঘুনাথ মন্দির আজও প্রাচীন পান্ডুলিপির ডিজিটাইজেশনে অগ্রণী এবং 'eGangotri' প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের অন্যান্য অংশের পান্ডুলিপিও ডিজিটাল রূপে সংরক্ষণ করছে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
রঘুনাথ মন্দির ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্দির ভগবান রামকে উৎসর্গীকৃত এবং তাঁর অনুগামীদের জন্য বিশেষ বিশ্বাসের কেন্দ্র। মন্দিরে উপস্থিত মূর্তি, চিত্র এবং ভাস্কর্য ধর্মীয় কাহিনিগুলিকে জীবন্ত রূপে উপস্থাপন করে। এখানে শালিগ্রাম পাথরের (নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে প্রাপ্ত জীবাশ্ম শঙ্খ) পূজা করা হয়, যা বিষ্ণুর প্রতীক বলে মনে করা হয়।
মন্দির চত্বরে চিত্রকলার মাধ্যমে ধর্মীয় কাহিনির পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলিও চিত্রিত করা হয়েছে। চিত্রগুলিতে কবীরের মতো সাধুদের ছবির সাথে সেই সময়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও অস্ত্রের বিবরণও অন্তর্ভুক্ত। মন্দিরে আয়োজিত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্থানীয় সম্প্রদায় ও তীর্থযাত্রীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
সন্ত্রাসী হামলা
রঘুনাথ মন্দির তার ইতিহাসে সন্ত্রাসী হামলার সম্মুখীন হয়েছে। ৩০ মার্চ ২০০২ তারিখে সন্ত্রাসবাদীরা প্রথমে বাজারের এলাকায় গ্রেনেড ছোঁড়ে এবং তারপর মন্দিরে প্রবেশ করে গুলি চালাতে শুরু করে। এই হামলায় ১০ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে চারজন নিরাপত্তা কর্মী এবং দুজন সন্ত্রাসী ছিল। এছাড়াও ৪০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়।
২৪ নভেম্বর ২০০২ তারিখে মন্দিরে দ্বিতীয় হামলা হয়, যখন পূজার সময় লস্কর-ই-তৈবার সন্ত্রাসবাদীরা বোমা বিস্ফোরণ ও গোলাগুলি চালায়। এই হামলায় ১৩ জন श्रद्धालु নিহত হয় এবং ৪০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়। এই ঘটনাগুলি মন্দিরের নিরাপত্তা ও প্রশাসনের উপর গুরুতর মনোযোগ আকর্ষণ করে।
অবস্থান ও পৌঁছানো
রঘুনাথ মন্দির জম্মু শহরের পুরানো অংশে অবস্থিত। শহরটির গড় উচ্চতা ৩৫০ মিটার। জম্মু সড়ক, রেল এবং বিমান পথে দেশের প্রধান অংশগুলির সাথে সংযুক্ত। জাতীয় সড়ক ১এ শহরটির পাশ দিয়ে গেছে।
জম্মু রেলওয়ে স্টেশন (জম্মু তাউই) দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা এবং অমৃতসরের সাথে সংযুক্ত। জম্মু বিমানবন্দর দিল্লি, শ্রীনগর এবং লেহ-এর জন্য বিমান পরিষেবার সুবিধা প্রদান করে। এই মন্দির তীর্থযাত্রীদের জন্য সহজেই প্রবেশযোগ্য।
শিক্ষাগত অবদান
মন্দির চত্বরে স্কুল ও গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব এটিকে শিক্ষাগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। পান্ডুলিপির সংরক্ষণ ও অধ্যয়ন, আরবি ও ফারসি গ্রন্থের অনুবাদ কর্ম এটিকে একটি বহু-সাংস্কৃতিক এবং বহু-ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র করে তোলে। এই উদ্যোগ কেবল ধর্মীয় সহিষ্ণুতাই বাড়ায় না, বরং ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রঘুনাথ মন্দির কেবল ভগবান রামের ভক্তির কেন্দ্রই নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি, স্থাপত্য, পান্ডুলিপি সংরক্ষণ এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীকও বটে। এর মহিমা, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক অবদান এটিকে জম্মু এবং সমগ্র ভারতের জন্য অনন্য করে তোলে। মন্দির সন্ত্রাসী হামলা এবং সময়ের অন্যান্য প্রভাব সত্ত্বেও তার মর্যাদা ও ধর্মীয় গুরুত্ব বজায় রেখেছে। রঘুনাথ মন্দির, তার অনন্য স্থাপত্য, সমৃদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহ এবং ধর্মীয় কার্যকলাপের মাধ্যমে, আগত প্রজন্মের জন্য ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের রক্ষক হিসেবে থাকবে।