কামাক্ষ্যা দেবী মন্দির: নারীশক্তি, তান্ত্রিকতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

কামাক্ষ্যা দেবী মন্দির: নারীশক্তি, তান্ত্রিকতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

ভারত বৈচিত্র্যের দেশ, যেখানে শ্রদ্ধা ও ভক্তির ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি প্রতিটি কোণে দৃশ্যমান। এই শ্রদ্ধাস্থলগুলির মধ্যে একটি অত্যন্ত রহস্যময়, ঐতিহাসিক এবং তান্ত্রিক গুরুত্ব সম্পন্ন মন্দির হল — কামাখ্যা দেবী মন্দির, যা আসামের গুয়াহাটি শহরের নীলাচল পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এই মন্দিরটি কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এমন একটি রহস্য যা ভারতীয় তান্ত্রিক পরম্পরা, স্ত্রী-শক্তি, এবং প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরে। এখানে দেবীর মূর্তির পূজা হয় না, বরং প্রাকৃতিক যোনি-আকৃতির একটি পাথরের পূজা করা হয়, যা স্ত্রী-শক্তি এবং সৃজনের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। এই মন্দিরটি ভারতীয় শক্তি সাধনার ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনন্য হিসেবে বিবেচিত হয়।

মন্দিরের পৌরাণিক मान्यता ও গুরুত্ব

কামাখ্যা মন্দির সম্পর্কে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, এটি সেই স্থান যেখানে সতীর শরীরের যোনি-অংশ পতিত হয়েছিল, যখন ভগবান শিব তাঁর শবদেহ নিয়ে তাণ্ডব করতে করতে মহাবিশ্বে ভ্রমণ করছিলেন। এই স্থানটি সতীর জননী শক্তি এবং সৃজনের প্রতিরূপ হয়ে ওঠে এবং এই কারণে এখানে যোনি রূপে দেবীর পূজা করা হয়। তান্ত্রিক গ্রন্থ কালিকা পুরাণ এবং যোগিনী তন্ত্রে এই স্থানটিকে দেবীর শক্তির কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানকার পূজা পদ্ধতি প্রধানত বামাচারা তন্ত্র সাধনা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে, যেখানে পশু বলি-র মতো প্রথাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অম্বুবাচী মেলা: যখন দেবীর ঋতুস্রাব হয়

কামাখ্যা মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অভিনব উৎসব হল অম্বুবাচী মেলা, যা দেবীর ঋতুস্রাবের উৎসব হিসেবে পালিত হয়। এটি প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে মন্দিরের গর্ভগৃহ তিন দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মনে করা হয় দেবী রজঃস্বলা হন। চতুর্থ দিনে মন্দিরের দরজা খোলা হয় এবং হাজার হাজার সাধক, ভক্ত, তান্ত্রিক এবং বিদেশী পর্যটকেরা এই অত্যাশ্চর্য তান্ত্রিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসেন।

মন্দিরের স্থাপত্য: স্থানীয়তা ও মিশ্রিত শৈলীর এক অসাধারণ সঙ্গম

কামাখ্যা মন্দিরের গঠন একটি অনন্য শৈলী 'নীলাচল শৈলী'-তে নির্মিত, যেখানে নাগর, বাংলা এবং ইসলামী স্থাপত্যের মিশ্রণ দেখা যায়। এর নির্মাণকার্য অষ্টম-নবম শতকে শুরু হয়েছিল এবং ষোড়শ শতকে কোচ রাজাদের তত্ত্বাবধানে এটি পুনরায় নির্মিত হয়। এর গঠনে পাথর এবং ইট উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে গম্বুজ আকারের শিখর অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

মন্দিরটি চারটি অংশে বিভক্ত:

  • গর্ভগৃহ: যেখানে দেবীর যোনি রূপের পূজা হয়।
  • কলাত্মা: পবিত্র মূর্তিগুলির স্থান।
  • পঞ্চরত্ন কক্ষ: প্রধান পূজা কক্ষ।
  • নৃত্যমন্ডপ: সভা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির স্থান।

শাক্তবাদ ও মহাবিদ্যাদের কেন্দ্র

কামাখ্যা মন্দির কেবল একজন দেবীর প্রতি উৎসর্গীকৃত নয়, এটি দশ মহাবিদ্যারও একটি প্রধান পীঠস্থান। দশ মহাবিদ্যা হলেন: কালী, তারা, ত্রিপুরসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী এবং কমলাত্মিকা। এদের মধ্যে তিনজন – ত্রিপুরসুন্দরী, মাতঙ্গী এবং কমলা – মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজমান, যেখানে অন্য সাতজন বিভিন্ন উপ-মন্দির কমপ্লেক্সে অবস্থিত। ভারতে আর কোথাও এই ধরনের মহাবিদ্যা-সমষ্টি দেখা যায় না, যা এই মন্দিরটিকে অত্যন্ত বিশিষ্ট করে তোলে।

কামাখ্যা: স্ত্রী-শক্তি ও স্বাস্থ্যের রহস্য

কামাখ্যা মন্দির কেবল তান্ত্রিক অনুষ্ঠান বা আধ্যাত্মিক শক্তির কেন্দ্রই নয়, বরং স্ত্রী-স্বাস্থ্যের প্রতীক হিসেবেও দেখা যায়। এখানে ঋতুস্রাব, যা সমাজে অনেক সময় নিষিদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাকে দেবীর সৃজনশীল শক্তি হিসেবে পূজা করা হয়। অম্বুবাচী মেলা, দেবীর রজঃস্বলা হওয়ার উৎসব, এই বার্তাটি দৃঢ়ভাবে দেয় যে ঋতুস্রাব একটি অপবিত্র প্রক্রিয়া নয় বরং এটি সৃষ্টির শক্তি। এই প্রতীকী পূজা শুধু সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিবর্তনই করেনি, বরং এটিও বলেছে যে স্ত্রী শরীরের সম্মান এবং উপলব্ধি জীবন ও সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

ঐতিহাসিক বিকাশ ও শাসনের অবদান

কামাখ্যা মন্দিরের নাম সর্বপ্রথম নবম শতাব্দীর ম্লেচ্ছ রাজবংশের বনমালবর্মার শিলালিপিতে পাওয়া যায়। পরে পাল, কোচ এবং আহোম শাসকেরা এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে কোচ রাজবংশের নর নারায়ণ এবং তাঁর সেনাপতি চিলারায় এটি নির্মাণ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আহোম শাসক শিব সিংহ এবং রাজেশ্বর সিংহও এখানে নির্মাণ কাজ করেন। মন্দিরের নৃত্যমন্ডপ তাঁদের শাসনকালেই নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরের দেওয়ালে সেই সময়ের অনেক মূর্তি ও শিলালিপি আজও দেখা যায়।

কামাখ্যা ও সমসাময়িক সমাজ

২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মন্দিরের প্রশাসন কামাখ্যা দেববাত্তার বোর্ড থেকে সরিয়ে বোর্ডেউরি সমাজের হাতে তুলে দেয়, যার ফলে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে আসে। আজ এই মন্দিরটি কেবল আসামের নয়, ভারতের একটি প্রধান ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত দর্শনের জন্য আসেন এবং তান্ত্রিক সাধকেরা শক্তির অনুভূতি লাভের জন্য এখানে সাধনা করেন।

বিশেষ প্রথা ও অনুষ্ঠান

পশু বলি: মন্দিরে আজও প্রতিদিন ছাগল বলি দেওয়া হয়, বিশেষ করে অম্বুবাচী বা বিশেষ পূজার অনুষ্ঠানে। যদিও বর্তমানে এর বিরুদ্ধে অনেক সামাজিক ও বিধিবদ্ধ আওয়াজ উঠছে। বামাচারা ও দক্ষিণাচারা পূজা পদ্ধতি: উভয় পদ্ধতির তান্ত্রিক সাধকেরা এখানে তাঁদের সাধনা করেন। সাক্ষাৎ অনুভূতির স্থান: কামাখ্যা কেবল আস্থার বিষয় নয়, বরং একটি জীবন্ত শক্তি ক্ষেত্র যেখানে সাধকেরা সাক্ষাৎ শক্তির অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

কামাখ্যা দেবী মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং ভারতের নারী-শক্তি, তান্ত্রিক সাধনা, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতীক। এই মন্দিরটি দেখায় যে সৃষ্টির শক্তি, তা শারীরিক হোক বা আধ্যাত্মিক, নারীর ভিতরেই নিহিত থাকে। এই মন্দির সামাজিক বাধাগুলি চ্যালেঞ্জ করে এবং একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে — যেখানে ঋতুস্রাব, যোনি, এবং স্ত্রী দেহকে অপবিত্র না মনে করে, বরং পূজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

Leave a comment