স্টেশনজুড়ে ভাঙাভাঙি, তিনদিন ধরে বন্ধ কবি সুভাষ, প্রশ্ন যাত্রীদের: আবার কবে চলবে ট্রেন?
দক্ষিণ শহরতলির ব্যস্ততম মেট্রো স্টেশন কবি সুভাষ—এই নামটাই হাজার হাজার নিত্যযাত্রীর নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু সেই স্টেশনেই আজ তিনদিন ধরে ঝুলছে বন্ধ সাইনবোর্ড। মূলত আপ প্ল্যাটফর্মের বাউন্ডারি ওয়ালে এবং তার উপরের কাচের স্লাইডিং কাঠামোতে দেখা গেছে চিহ্নিত ফাটল। সেই জায়গাগুলো ভেঙে ফেলা শুরু হয়েছে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার দিকটা মাথায় রেখে। নির্মাণকাজ চলছে দিনরাত এক করে, কিন্তু ঠিক কবে আবার সচল হবে এই স্টেশন—তা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা।
দক্ষিণের শেষ স্টেশন থেমে গেলে থমকে যায় যাত্রীদের গতি—সবচেয়ে বেশি বিপাকে নিউ গড়িয়া
ব্লু লাইনের দক্ষিণ প্রান্তে কবি সুভাষ শেষ স্টেশন। এখান থেকেই শুরু হয়ে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত ছুটে চলে মেট্রোর দৈনন্দিন রেলসেবা। এই স্টেশনই নিউ গড়িয়া, পূর্ব যাদবপুর এবং সংলগ্ন অঞ্চলগুলোর প্রধান সংযোগস্থল। স্টেশন হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। অল্টারনেটিভ ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা না থাকায় ঘন্টার পর ঘন্টা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। স্কুল-কলেজের পড়ুয়া থেকে অফিসযাত্রী—সবাই একসুরে বলছেন, আমাদের লাইফটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।
রিপ্লেসমেন্ট নয়, পুনর্গঠনই একমাত্র উপায়—সময় লাগতে পারে এক বছরেরও বেশি
স্টেশনের স্ট্রাকচারাল ক্ষতি এতটাই মারাত্মক যে শুধু মেরামতি করে এর রেহাই নেই। রেলের ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনের হিসেব অনুযায়ী, নতুন স্টেশন তৈরি করতে লাগবে ন্যূনতম ৯-১০ মাস সময়। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, কাজ শেষ হতে সময় এক বছর পেরিয়ে যেতে পারে অনায়াসেই। দক্ষিণ কলকাতার লক্ষাধিক যাত্রী তাই এক প্রকার 'স্টেশনশূন্য' পরিস্থিতিতে পড়েছেন। রেল কর্তৃপক্ষও বলছে, স্থায়ী সমাধান ছাড়া গলদমুক্ত পরিষেবা সম্ভব নয়।
টাকার অঙ্কও কম নয়—৯ কোটি ৪২ লক্ষ টাকায় গড়ে উঠবে নতুন স্টেশন, ফাটল ধরা প্ল্যাটফর্মই মূল কারণ
মেট্রো রেলের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট ৯.৪২ কোটি টাকার বাজেটে তৈরি হবে সম্পূর্ণ নতুন স্টেশন কাঠামো। শুধু পিলার নয়, প্ল্যাটফর্মের গোড়ার অংশেও ধরেছে ফাটল। অনেক জায়গায় কংক্রিট খসে পড়ছে। সেই কারণে শুধুমাত্র 'প্যাচওয়ার্ক' বা ‘সার্ভে-সাপেক্ষ মেরামতি’ যথেষ্ট নয়। সম্পূর্ণ পুনর্গঠনই এখন একমাত্র রাস্তা বলে মনে করছে রেল কর্তৃপক্ষ।
২১টি পিলারের মধ্যে ৪টিতে ধরা পড়েছে বড় ফাটল, বাকিগুলিতেও রয়েছে ক্ষতচিহ্ন
কবি সুভাষ স্টেশনে মোট পিলারের সংখ্যা ২১। এর মধ্যে অন্তত ৪টি পিলারে দেখা গেছে চোখে পড়ার মতো ফাটল। তবে ফাটল শুধু ওগুলিতেই সীমাবদ্ধ নয়। অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছে, বাকি পিলারগুলোর অনেকেও রয়েছে সূক্ষ্ম ক্ষয়-ক্ষতির চিহ্ন। অর্থাৎ গোটা স্টেশনটাই ধীরে ধীরে হয়ে পড়ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে বড়সড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যেতই।
কর্মীসংকট যেন বড় বাঁধা—প্রায় ৪০ শতাংশ স্টাফ নেই, দেরি বাড়াতে পারে কাজের গতি
রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের একটি গোপন নথি অনুযায়ী, অনুমোদিত কর্মীসংখ্যার থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ স্টাফ কম রয়েছে বর্তমানে। যার ফলে ঠিকঠাক গতি পাচ্ছে না স্টেশনের মেরামতির কাজ। এই কর্মী সংকটের জেরে রেলের নির্মাণ শাখাকেও বাইরে থেকে সংস্থা নিযুক্ত করতে হতে পারে, যাতে সময়মতো কাজ শেষ করা যায়। এতে বাড়তে পারে খরচ এবং প্রশাসনিক জটিলতা।
রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির ধারাবাহিকতা—এক বছরে ঘটেছে একাধিক ছোট বড় দুর্ঘটনা
গত এক বছরে দক্ষিণ শহরতলির এই মেট্রো স্টেশনে ঘটেছে একাধিক ছোটখাটো দুর্ঘটনা। প্ল্যাটফর্মের ধারে বাউন্ডারির টাল খসে পড়া থেকে শুরু করে ছাঁদ থেকে জল পড়ার মতো সমস্যাও চিহ্নিত হয়েছে। সেই ঘটনাগুলিকে তখন গুরুত্ব না দেওয়ায় পরিস্থিতি আজকে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ‘প্রশাসনিক অবহেলা’ বলতেই হচ্ছে। এবার চাই আরও সক্রিয় নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা।
কবি সুভাষ থামলে, থেমে যায় দক্ষিণ কলকাতার ছন্দ—এই স্টেশন কত দ্রুত ফিরবে ছন্দে, এখন তারই অপেক্ষা
নিউ গড়িয়ার মানুষের কাছে কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন কেবলমাত্র যাতায়াতের জায়গা নয়, এ যেন তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের এক অঙ্গ। সেই স্টেশনই এখন ঝুঁকিপূর্ণ, বন্ধ এবং নির্মাণাধীন। ফের কবে সচল হবে, তার সঠিক দিনক্ষণ নেই এখনও। আপাতত প্রতিশ্রুতি, মেরামতির কাজ শেষ হবে ‘সর্বোচ্চ গুরুত্বে’। তবে যাত্রীদের মনে প্রশ্ন—দক্ষিণের শেষ স্টেশন কি আবার জাগবে আগের মতো?