একদিনের ঝগড়া বা চড়কে বধূ নির্যাতন বলা যাবে না

একদিনের ঝগড়া বা চড়কে বধূ নির্যাতন বলা যাবে না

কলকাতা হাইকোর্ট আবারও সতর্ক বার্তা দিয়েছে, যে বধূ নির্যাতনের আইন প্রতিশোধমূলক মনোবৃত্তিতে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা চলবে না। বিচারপতি অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় শুক্রবার একটি মামলার শুনানির সময় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, শুধুমাত্র একদিনের ঝগড়া, উত্তেজনা বা সামান্য মারধরকে কখনোই “নিষ্ঠুরতা” বা দাম্পত্য নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা যাবে না। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এমন ধরনের অভিযোগ অনেক সময় ব্যক্তিগত বিরোধ বা প্রতিশোধের কারণে দায়ের করা হয়, যা আইনের যথার্থ প্রয়োগকে বিকৃত করে।

আদালতের পর্যবেক্ষণ: আইনের অপব্যবহার

বৃহস্পতিবার আদালত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে দায়ের অভিযোগ খারিজ করে স্বামীকে স্বস্তি দিয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, স্ত্রী তার স্বামীকে হেনস্থা করার জন্য বধূ নির্যাতনের আইনকে ব্যবহার করেছেন। আদালত এ ধরনের আইন ব্যবহার করা হলে তা আদালতের প্রতি বিশ্বাসহীনতার সৃষ্টি করে এবং সত্যিকার নির্যাতিতদের জন্য আইনের প্রভাব কমিয়ে দেয়। বিচারপতি সতর্ক করেছেন, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রমাণ ও সত্যতার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী দাম্পত্য বিবাদ

বর্ধমানের ওই দম্পতির বিবাহিত জীবন শুরু থেকেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। ২০২২ সালের ৭ জুলাই ওই গৃহবধূ স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে উল্লেখ ছিল, স্বামী ও তার পরিবার তাঁকে আটকে রেখে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন এবং তার উপর মানসিক ও শারীরিক চাপ প্রয়োগ করেছেন। তবে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অভিযোগে উল্লেখিত ঘটনার প্রমাণ যথেষ্ট নয়, ফলে আদালত সেই অভিযোগ খারিজের সিদ্ধান্ত নেন।

অতীতের অভিযোগ ও পাল্টা মামলা

স্বামীর দাবি, স্ত্রী এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ২০১৯ সালে স্ত্রী নিজের টাকা ও গয়না নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি ত্যাগ করেন। স্বামী তখন পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। ২০২১ সালে স্ত্রী পাল্টা মামলা দায়ের করেন, যদিও তাতে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ ছিল না। পরবর্তী বছর সেই ধারাটি যোগ করে মামলা পুনর্গঠন করা হয়। আদালত বিবেচনা করেছেন, এটি একটি স্পষ্ট উদাহরণ যেখানে প্রতিশোধমূলক মনোভাব আইনের অপব্যবহারে রূপ নিয়েছে।

হাইকোর্টের রায়ের প্রভাব

বিচারপতি মুখোপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথাও উল্লেখ করেছেন। রায়ে বলা হয়েছে, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলকভাবে বধূ নির্যাতনের আইন প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। এই প্রেক্ষাপটে আদালত মনে করছে, শুধুমাত্র প্রমাণভিত্তিক, সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই আইন প্রয়োগ করা উচিত। এফআইআর এবং পুলিশের চার্জশিটে কোনও অপরাধের প্রমাণ না থাকার কারণে আদালত এফআইআর খারিজের নির্দেশ দেন।

আইনের অপব্যবহারের প্রতি সতর্কবার্তা

হাইকোর্টের রায় স্পষ্ট করছে, বধূ নির্যাতনের আইনকে কখনোই ছোটখাট বিবাদ, উত্তেজনা বা পারিবারিক ঝগড়ার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। আইন শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য। আদালতের নজরে প্রতিশোধমূলক অভিযোগ আসার আগে আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়া সতর্কভাবে পরিচালনা করা অপরিহার্য।

সমাজে প্রভাব

এই রায় সমাজকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়—দাম্পত্য বিবাদে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে, প্রতিটি অভিযোগের প্রমাণ এবং সত্যতা যাচাই করতে হবে। এই রায় পাঠকদের মনে করিয়ে দেয়, আইন শুধুমাত্র নির্যাতিতদের সুরক্ষার জন্য প্রযোজ্য এবং কোনভাবেই প্রতিশোধমূলক উপায়ে ব্যবহার করা উচিত নয়।

Leave a comment