জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ ব্লকের পেলকুগছ, চেকরমারি ও গিরানগছ গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন আতঙ্ক। একের পর এক মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন, অনেকে আবার হেপাটাইটিস-এ বা লেপ্টোস্পাইরার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। হঠাৎ করে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য দফতর নড়ে চড়ে বসেছে। শনিবার থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশেষ পদক্ষেপ শুরু করেছে প্রশাসন।
গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির, তৎপর পিএইচই
অসুস্থতার খবর প্রকাশ্যে আসতেই সকাল থেকেই স্বাস্থ্য দফতরের তরফে এলাকায় শুরু হয়েছে মেডিক্যাল ক্যাম্প। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের উপস্থিতিতে গ্রামের মানুষদের বিনামূল্যে পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পানীয় জল পরিশোধনের দায়িত্ব নিয়েছে পিএইচই। কলের জলে ব্লিচিং পাউডার মেশানো হচ্ছে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা প্রচার চালানো হচ্ছে।
শিশু-কিশোররাই বেশি আক্রান্ত
সূত্রের খবর, আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও কিশোরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অনেকের চোখ হলুদ হয়ে যাচ্ছে, কারও কারও মধ্যে দেখা দিচ্ছে প্রবল বমিভাব, আবার কারও শরীরে দীর্ঘদিন ধরে জ্বর কমছে না। এই লক্ষণগুলো দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। গ্রামজুড়ে ছোটোদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগে ঘুম উড়েছে অভিভাবকদের।
সংক্রমণের উৎস অপরিস্রুত জল ও ইঁদুরের মূত্র
স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্টে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। মূলত অপরিস্রুত পানীয় জল ও ইঁদুরের মূত্র থেকেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, গ্রামের নোংরা জলাশয় ও অপরিষ্কার পরিবেশ সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ী। শুধু তাই নয়, মানুষের অসচেতনতা ও সতর্কতার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
টেস্ট রিপোর্টে মিলল চমকপ্রদ তথ্য
রাজগঞ্জ ব্লকের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা ৪০ জন রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষায় উঠে এসেছে উদ্বেগজনক ফলাফল। তার মধ্যে ১৫ জনের শরীরে লেপ্টোস্পাইরা, ১৪ জনের শরীরে হেপাটাইটিস-এ, দু’জনের শরীরে স্ক্রাব টাইফাস এবং একজনের শরীরে একাধিক রোগের জীবাণু ধরা পড়েছে। এমন ফলাফলের পর চিকিৎসক মহলেও শোরগোল পড়ে গেছে। একাধিক সংক্রমণ একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আতঙ্কে গ্রামবাসী, নজরদারিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা
রোগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে বাড়ি থেকে বের হতে চাইছেন না, আবার কেউ কেউ দূরের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যদিকে, স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিটি বাড়ি ঘুরে রোগীদের খোঁজ নিচ্ছেন এবং প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি করাচ্ছেন। প্রতিটি স্কুল, আঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও বাজার এলাকায় বিশেষ নজরদারি চালানো হচ্ছে।
প্রশাসনের উদ্যোগে খানিক স্বস্তি
তবে আতঙ্কের মধ্যেও খানিক স্বস্তি দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের দ্রুত পদক্ষেপ। মেডিক্যাল ক্যাম্প বসিয়ে সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের জন্য এলাকাজুড়ে কল পরিষ্কার করে ব্লিচিং দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রত্যেকটি বাড়ির কল আলাদা করে পরিষ্কার করা হয়েছে, যাতে জলবাহিত রোগ আর না ছড়ায়। ফলে গ্রামবাসী কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছেন।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দাবি
স্থানীয়দের দাবি, শুধু এই মুহূর্তে শিবির বসানোই যথেষ্ট নয়। গ্রামে স্থায়ীভাবে পরিশ্রুত পানীয় জল ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি না হলে এই ধরনের সংক্রমণ বারবার ফিরে আসবে। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে যদিও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। তবে বাস্তবে কতটা প্রয়োগ হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
উপসংহার: সতর্ক থাকাই একমাত্র পথ
রাজগঞ্জ ব্লকের এই পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করল, পানীয় জল ও পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের সম্পর্ক কতটা গভীর। প্রশাসনের অস্থায়ী পদক্ষেপ মানুষকে খানিকটা স্বস্তি দিলেও, আসল সমাধান হবে সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখায়। এখন দেখার বিষয়, এই রোগের প্রাদুর্ভাব কত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।