মহাভারতের শিক্ষা: আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা

মহাভারতের শিক্ষা: আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা

মহাভারত কেবল একটি যুদ্ধের কাহিনী নয়, বরং এটি জ্ঞান, নীতি, ধর্ম এবং জীবন পরিচালনার এমন এক গ্রন্থ যা 'পঞ্চম বেদ' নামে পরিচিত। এতে বর্ণিত বহু ঘটনা এবং চরিত্র আজকের আধুনিক জীবনেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে শান্তি পর্ব, अनुशासन পর্ব এবং বন পর্ব থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো আমাদের আত্মবিশ্বাস, বিবেক এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।

মিথ্যার সঙ্গে সাফল্য স্থায়ী হয় না

শান্তি পর্বে ভীষ্ম পিতামহ যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন যে, যারা মিথ্যা কথা বলে বা মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তারা কখনও সত্য জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এই ধরনের অজ্ঞানতা তাদের বিভ্রমের জগতে নিয়ে যায়, যেখানে আসল সাফল্য কেবল একটি মরীচিকা হয়ে থাকে।

উত্তম জ্ঞানই স্বর্গ

মহাভারত অনুসারে, এই পৃথিবীতে যা সত্য জ্ঞান ও শিক্ষা, তাই স্বর্গের সমান। যেখানে অজ্ঞানতা এবং খারাপ অভ্যাসই মানুষকে নরকের দিকে নিয়ে যায়। শান্তি পর্ব এই ধারণাটিকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করে যে জীবনে প্রকৃত সমৃদ্ধি শিক্ষা, জ্ঞান এবং সৎকর্মের মাধ্যমেই অর্জিত হয়।

ধর্মের অবমাননাকারীর ধ্বংস অনিবার্য

মহাভারতের বন পর্বে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ধর্মে বিশ্বাস রাখে না এবং সাধু, সন্ত, জ্ঞানী ব্যক্তিদের অপমান করে, তাদের ধ্বংস দ্রুত নিশ্চিত। এমন লোকেরা বাইরে যত ঐশ্বর্য দেখাক না কেন, তাদের জীবনে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য থাকে না।

মোহ ও লোভের কুফল

শান্তি পর্বে আরও বলা হয়েছে যে, মোহ ও লোভ জীবনকে ছোট এবং দুঃখজনক করে তোলে। অন্যদিকে, সত্য ও ধর্ম অনুসরণ করলে মানুষ দীর্ঘায়ু ও সুখী হয়। এই বার্তাটি আজকের দিনেও একইভাবে প্রযোজ্য, যেখানে মানুষ শারীরিক সুখের মোহে নিজেদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দেয় না।

পুণ্য কাজে দেরি নয়

শান্তি পর্বের একটি প্রধান শিক্ষা হল, যে কাজ পুণ্যের এবং যা সমাজ বা অন্য কারও উপকারে আসে, তা অবিলম্বে শুরু করা উচিত। সুযোগ বিলম্বিত করলে সেই পুণ্যের ফল হাতছাড়া হয়। আজকের ব্যস্ত জীবনে এই শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পুণ্যের প্রদর্শন করা উচিত নয়

অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে যে, পুণ্য কাজ অবশ্যই করুন, তবে তা প্রদর্শন করবেন না। যে ব্যক্তি কেবল সমাজে প্রশংসা পাওয়ার জন্য বা লোক দেখানোর জন্য ধর্ম-কর্ম করে, সে তার শুভ ফল লাভ করে না। আড়ম্বরমুক্ত জীবনই প্রকৃত পুণ্যের পরিচয়।

সবার সঙ্গে সমান আচরণ করুন

মহাভারতের বন পর্বে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি সবার সাথে একই রকম আচরণ করে এবং অন্যদের প্রতি করুণা ও প্রেমের অনুভূতি রাখে, সে জীবনে সমস্ত সুখ লাভ করে। সমাজে সাম্য ও দয়ার भावना থেকেই একটি সমৃদ্ধ জীবন সম্ভব।

মন ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি

বন পর্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল, যে ব্যক্তি নিজের মন ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে কখনও ঈর্ষা, বিদ্বেষ বা দুঃখের অনুভূতি গ্রাস করতে পারে না। অন্যদের সাফল্য দেখেও সে ঈর্ষা করে না এবং নিজের আত্ম-শান্তি বজায় রাখে।

ভীষ্ম পিতামহের শিক্ষা আজও পথপ্রদর্শক

মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও ভীষ্ম পিতামহ যুধিষ্ঠিরকে শান্তি পর্বে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, তা আজকের রাজনীতি, সমাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনেও পথপ্রদর্শক হতে পারে। এতে আত্মসংযম, ন্যায়পরায়ণতা, কর্মনিষ্ঠা এবং বিবেকের সাথে জীবন যাপনের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এই শিক্ষাগুলোকে কেবল ধর্মীয় গ্রন্থের অংশ হিসেবে গণ্য করা ভুল হবে। এগুলো জীবনের প্রতিটি মোড়ে আত্ম-বিশ্লেষণ, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং সাফল্যের স্তম্ভ হতে পারে। মহাভারতের গভীরতায় লুকানো এই জ্ঞান আজকের যুগেও ততটাই প্রাসঙ্গিক, যতটা হাজার বছর আগে ছিল।

Leave a comment