জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী: জীবন, দর্শন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা

জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী: জীবন, দর্শন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রণী নেতা, সত্য ও অহিংসার প্রতীক ছিলেন। তিনি অসহযোগ, লবণ সত্যাগ্রহ এবং সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

মহাত্মা গান্ধী: যাঁর আসল নাম ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, তাঁর জন্ম ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দরে। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা এবং ‘জাতির পিতা’ হিসেবে পরিচিত। গান্ধীজি সত্য ও অহিংসার পথ অবলম্বন করে ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তাঁর জীবন ভারতীয় জনগণের জন্য আদর্শ ও দিশা দেখানোর উৎস হয়ে ওঠে।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

গান্ধীজির জন্ম হয়েছিল এক বানিয়া পরিবারে, যা ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবসা ও অর্থের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁর পিতা করমচাঁদ গান্ধী পোরবন্দর ও রাজকোটের দেওয়ান ছিলেন এবং তাঁর মা পুতলীবাঈ অত্যন্ত ধার্মিক ও সরল জীবনযাপনকারী মহিলা ছিলেন। মোহনদাস রাজকোটে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর বিবাহের বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর, যখন তাঁর বিয়ে হয় কস্তুরবা গান্ধীর সাথে। শিক্ষা চালিয়ে যেতে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ওকালতির ডিগ্রি অর্জন করেন।

ইংল্যান্ডে থাকাকালীন গান্ধীজি সম্পূর্ণরূপে নিরামিষ জীবনযাপন শুরু করেন এবং ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। তিনি হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, বাইবেল ও কোরআন অধ্যয়ন করেছিলেন, যা তাঁর জীবন ও দর্শনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহের সূচনা

১৮৯৩ সালে গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা যান, যেখানে তিনি ভারতীয়দের প্রতি জাতিগত বৈষম্য লক্ষ্য করেন। সেখানে ভারতীয়দের বিশেষ ট্রেনের কামরায় ভ্রমণ করতে বাধা দেওয়া হতো এবং জনসমক্ষে বৈষম্য করা হতো। একটি ঘটনায় তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়, যা তাঁকে জাতিগত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে অনুপ্রাণিত করে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি ‘নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতীয়দের অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এখানে তিনি সত্যাগ্রহের পদ্ধতি বিকশিত করেন, যা ছিল সংগ্রাম ও প্রতিবাদের এক অহিংস উপায়। তিনি ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারকেও উৎসাহিত করেন।

ভারতে ফিরে স্বাধীনতা সংগ্রাম

গান্ধীজি ১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি সবরমতী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং খাদী আন্দোলন শুরু করেন। তিনি মানুষকে আত্মনির্ভরশীল হতে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। গান্ধীজি ১৯১৭ সালে চম্পারণ ও খেড়া আন্দোলনে কৃষকদের অধিকারের জন্য সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেন।

তাঁর প্রধান অবদান ছিল সত্যাগ্রহ ও অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। তিনি মানুষকে প্রতিবাদের শক্তি শিখিয়েছিলেন এবং শোষিত সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করেছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলন ও লবণ সত্যাগ্রহ

১৯১৯ সালে গান্ধীজি রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের ডাক দেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলনকে পরিচালিত করেন।

১৯৩০ সালে তিনি ডান্ডি মার্চের নেতৃত্ব দেন, যেখানে লবণ করের বিরোধিতা করে অহিংসভাবে আইন ভঙ্গ করা হয়। এই আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে ওঠে।

সামাজিক সংস্কারের জন্য প্রচেষ্টা

গান্ধীজির সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সমতা ও ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তিনি অস্পৃশ্যতা ও জাতিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। হরিজনদের উন্নতির জন্য তিনি অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি নারীর অধিকার ও শিক্ষার জন্য নিরন্তর অনুপ্রাণিত করেছেন।

গান্ধীজি গ্রামীণ ভারতের উন্নয়ন এবং স্বদেশী শিল্পের প্রচারে জোর দিয়েছিলেন। তিনি ‘নয়ী তালিম’ (শিক্ষার নতুন পদ্ধতি) এবং ‘গ্রাম স্বরাজ’-এর ধারণা প্রবর্তন করেন। তাঁর দৃষ্টিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল আত্মনির্ভরশীল নাগরিক তৈরি করা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা শেখানো।

ভারতের স্বাধীনতা ও বিভাজন

গান্ধীজি ভারতের বিভাজন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করেন। বিভাজনের সময় তিনি বিহার, বাংলা এবং অন্যান্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর জীবন সর্বদা ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা এবং অহিংসার নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

জীবনের আদর্শ ও প্রভাব

মহাত্মা গান্ধী সত্য, অহিংসা এবং নৈতিকতাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন যে অহিংসার মাধ্যমেও ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব। তাঁর আদর্শ গ্রহণকারী অনেক বিশ্বনেতার ওপর তাঁর প্রভাব পড়েছিল, যেমন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং স্টিভ বিকো।

গান্ধীজির জন্মদিন ২ অক্টোবর 'গান্ধী জয়ন্তী' হিসেবে পালিত হয়। জাতিসংঘ এটিকে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাঁর দর্শন আজও শিক্ষা, রাজনীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস।

মহাত্মা গান্ধী কেবল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাই ছিলেন না, বরং তিনি সত্য, অহিংসা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পথও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর জীবন সরল জীবন, আত্মসংযম এবং সেবার নীতির প্রতীক। তাঁর সংগ্রাম ও চিন্তাভাবনা আজও বিশ্বজুড়ে মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

Leave a comment