নেপালে চলমান রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বাড়ছে। পূর্বে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নাম আলোচিত হলেও, বর্তমানে নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটির প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং ভারতে পড়াশোনা করা ইঞ্জিনিয়ার, কুলমান ঘিসিংকে প্রধান দাবিদার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
নেপাল সংবাদ: নেপালে সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তুতি চলছে। কাঠমান্ডু থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, নতুন প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে কুলমান ঘিসিংয়ের নাম সবার সামনে রয়েছে। ভারতের জামশেদপুরে প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করা ঘিসিং নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটিতে দুই মেয়াদে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তাকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বানানোর আলোচনা জোরদার হচ্ছে, যা নেপালের রাজনীতিতে একটি নতুন মোড় আসার সম্ভাবনা তৈরি করছে।
ভারত থেকে পড়াশোনা করে নেপালের শক্তি খাতে গড়েছেন স্বতন্ত্র পরিচিতি
কুলমান ঘিসিংয়ের জন্ম ১৯৭০ সালের ২৫ নভেম্বর নেপালের রামছাপ জেলায়। তিনি ভারতের জামশেদপুর থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন, এরপর তিনি নেপালে ফিরে এসে শক্তি খাতে সক্রিয় হন। তার কর্মজীবনের শুরুটা সাধারণ স্তরে হলেও, তার কাজের পদ্ধতি ও নতুনত্ব দ্রুত তাকে পরিচিতি এনে দেয়। ভারত থেকে পড়াশোনা করার অভিজ্ঞতা তার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে এবং এর ফলেই তিনি নেপালে শক্তি সংস্কারের নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
ভারত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগত অভিজ্ঞতা তাকে একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিল। এই কারণেই তিনি কেবল একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞই নন, একজন দূরদর্শী ব্যবস্থাপক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন। নেপালে ফিরে আসার পর তিনি দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং সংস্কারের দিকে ठोस পদক্ষেপ নেন। তার স্বচ্ছ কার্যপদ্ধতি এবং শক্তিশালী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাকে সাধারণ নাগরিক থেকে নীতি নির্ধারকদের কাছে বিশ্বস্ত করে তোলে।
লোডশেডিং দূর করে হয়েছেন "বিদ্যুৎ মানব", গ্রামীণ অঞ্চলেও ছড়িয়েছেন আলো
নেপাল দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যুৎ সংকট ও দীর্ঘস্থায়ী লোডশেডিংয়ের সঙ্গে লড়াই করে আসছিল। ২০১৬ সালে কুলমান ঘিসিংকে নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটির (NEA) ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত করা হয়, এরপর তিনি এই সমস্যার সমাধান করার সংকল্প করেন। তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেন। এর ফলস্বরূপ, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নেপাল বিদ্যুৎ কাটার সমস্যা কাটিয়ে ওঠে।
গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া তার কাজের অন্যতম প্রধান অংশ ছিল। যেখানে একসময় মানুষ অন্ধকারে বসবাস করতে বাধ্য হত, সেখানে এখন ঘরে ঘরে আলো পৌঁছে গেছে। তার এই উদ্যোগ তাকে সাধারণ জনগণের মধ্যে "বিদ্যুৎ মানব" উপাধিতে ভূষিত করে। জনগণ প্রথমবার অনুভব করতে পারে যে প্রশাসনিক সততা ও সঠিক নীতি দ্বারা যেকোনো জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব। এই কারণেই তার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
কেপি ওলি সরকারের সাথে সংঘর্ষের পর পদচ্যুত
কুলমান ঘিসিংয়ের কর্মজীবন সবসময় মসৃণ ছিল না। ২০২৫ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সরকার তাকে হঠাৎ করেই NEA-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদ থেকে সরিয়ে দেয়। মনে করা হয়, তিনি কিছু শিল্পপতির বিদ্যুতের বিল মকুব করতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ফলে সরকার ও বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী অসন্তুষ্ট হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে এই পদক্ষেপটি তার জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়নি। বরং, তার জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যায়। তরুণ প্রজন্ম এবং সাধারণ জনগণ এটিকে একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিল যে তিনি চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে অস্বীকার করেছেন। তার বরখাস্তকে ক্ষমতা ও শিল্পপতিদের যোগসাজশের বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে কুলমান ঘিসিংয়ের মতো নেতারা কেবল পদের কারণে নয়, তাদের কাজ ও সততার কারণে মানুষের মনে স্থান করে নেন।
প্রথমবার বিদ্যুৎ রপ্তানি করে নেপালকে এনে দিয়েছেন নতুন পরিচিতি
কুলমান ঘিসিংয়ের কর্মজীবনে ভারত থেকে পড়াশোনা করার সম্পর্কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি কেবল ভারতেই শিক্ষা লাভ করেননি, শক্তি খাতেও ভারত থেকে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছেন। তার নেতৃত্বে নেপাল ২০২৩-২৪ সালে প্রথমবার ভারতে বিদ্যুৎ রপ্তানি শুরু করে। এই অর্জন নেপালের অর্থনীতি ও শক্তি খাতের জন্য ঐতিহাসিক বলে বিবেচিত হয়েছে।
বিদ্যুৎ রপ্তানি নেপালকে একটি নতুন অর্থনৈতিক পথে নিয়ে এসেছে। দেশকে শক্তি স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং রাজস্ব অর্জনের জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। কুলমান ঘিসিং জলবিদ্যুৎ খাতকে পুনরুজ্জীবিত করে এটিকে আঞ্চলিক সহযোগিতার উদাহরণে পরিণত করেছেন। ভারতের সাথে তার এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে শক্তি খাতে গভীর সহযোগিতার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি করে।