যখন দেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির দাপট ছিল, তখন একটি ভারতীয় ব্র্যান্ড ঐতিহ্যপূর্ণ চিন্তা, যোগ এবং স্বদেশী ধারণাকে শক্তি করে বাজারে নিজেদের আলাদা জায়গা তৈরি করে নেয়। পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ কেবল ভারতীয় ভোক্তাদের ভরসা অর্জন করেনি, আন্তর্জাতিক স্তরেও একটি শক্তিশালী পরিচিতি তৈরি করেছে। এই যাত্রা শুধু লাভের ছিল না, বরং সমাজসেবা, স্বাস্থ্য এবং সংস্কৃতির উন্নতির উদাহরণও হয়ে উঠেছে।
যোগ এবং আয়ুর্বেদকে পরিচয়ের ভিত্তি তৈরি করা
পতঞ্জলির ভিত্তিই ছিল যোগ এবং আয়ুর্বেদের নীতির উপর। ব্র্যান্ডের প্রতিটি পণ্যে এই মৌলিক নীতিগুলির ঝলক স্পষ্ট দেখা যায়। তা সে টুথপেস্ট হোক, সাবান হোক বা খাদ্যসামগ্রী, সব কিছুতেই 'প্রাকৃতিক' এবং 'রাসায়ন-মুক্ত' ভাবমূর্তি প্রধান রূপে ফুটে ওঠে।
স্বামী রামদেবের ভাবমূর্তি কোম্পানির ব্র্যান্ডকে এমন একটি মুখ হিসেবে পেশ করেছে যিনি কেবল প্রচার করেন না, বরং জীবনযাপন করে দেখান। এটাই কারণ যে পতঞ্জলির পণ্যের সঙ্গে একটি আবেগপূর্ণ সম্পর্কও দেখা যায়।
ব্র্যান্ডিংয়ের পদ্ধতি আলাদা, তবে কার্যকরী
যেখানে অন্য কোম্পানিগুলি তাদের পণ্য শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছায়, সেখানে পতঞ্জলি একটি আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিপণনের ভিত্তি বানিয়েছে। টিভিতে আসা যোগ সেশন, স্বামী রামদেবের সরাসরি অনুষ্ঠান, এবং পতঞ্জলির বিজ্ঞাপনে ভারতীয় সংস্কৃতির কথা, এই সব মিলিয়ে ব্র্যান্ডকে সাধারণ মানুষের খুব কাছে এনে দিয়েছে।
পতঞ্জলি কখনও নিজেকে শুধুমাত্র একটি এফএমসিজি ব্র্যান্ড বলেনি, বরং সবসময় দেখিয়েছে যে এর উদ্দেশ্য হল সমাজকে সুস্থ, স্বনির্ভর এবং নৈতিক করে তোলা।
স্বদেশীকে শক্তি হিসেবে তৈরি করা
পতঞ্জলির বিকাশে 'স্বদেশী' ধারণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ব্র্যান্ডটি তাদের প্রতিটি পণ্যকে 'ভারতের' বলে উল্লেখ করেছে এবং গর্বের সঙ্গে প্রচার করেছে। দেশে আত্মনির্ভর ভারত-এর ঢেউ ওঠার অনেক আগে পতঞ্জলি 'স্বদেশী আপ্নাও' (স্বদেশী গ্রহণ করুন)-এর नारा बुलंद করে দিয়েছিল।
লোকেরাও এই অনুভূতিকে খোলা মনে গ্রহণ করেছে। বিদেশি ব্র্যান্ডের চাকচিক্যের মাঝে যখন কোনও দেশীয় ব্র্যান্ড ভারতীয় ভাষা, আয়ুর্বেদ এবং ঐতিহ্যের কথা বলে, তখন মানুষ তার মধ্যে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। এটাই কারণ যে পতঞ্জলি গ্রামীণ ভারত থেকে শুরু করে শহরের ভোক্তাদের মধ্যেও নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছে।
নেতৃত্বে ভারসাম্য: স্বামী রামদেব ও আচার্য বালকৃষ্ণের জুটি
কোম্পানির ফ্রন্টে যেখানে স্বামী রামদেবের ভাবমূর্তি একজন আধ্যাত্মিক যোগ গুরুর, সেখানে ব্যাকএন্ডের কमान সামলেছেন আচার্য বালকৃষ্ণ। তাঁর ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং ব্যবস্থাপনার জোরে পতঞ্জলি ঐতিহ্যপূর্ণ পদ্ধতির পাশাপাশি আধুনিক ব্যবসায়িক কাঠামোকেও গ্রহণ করেছে।
আচার্য বালকৃষ্ণ সাপ্লাই চেইন, রিটেল নেটওয়ার্ক এবং উৎপাদন ইউনিটগুলিকে এমনভাবে সংগঠিত করেছেন যে পতঞ্জলি ভারতের প্রতিটি কোণে পৌঁছাতে পেরেছে। তাঁর নেতৃত্বে পতঞ্জলি গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মসংস্থানও বাড়িয়েছে এবং স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে ঔষধি গাছ কিনে কৃষি-ভিত্তিক উদ্যোগকেও উৎসাহিত করেছে।
শিক্ষা এবং যোগকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া
পতঞ্জলি কেবল পণ্য বিক্রি করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ব্র্যান্ডটি শিক্ষা, যোগ এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। হরিদ্বারে অবস্থিত পতঞ্জলি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভারতীয় বেদ, আয়ুর্বেদ, যোগ এবং বিজ্ঞানকে একত্রিত করে নতুন প্রজন্মকে প্রাচীন জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করছে।
যোগের ক্ষেত্রে স্বামী রামদেবের অবদানকে আজ বিশ্বজুড়ে सराহা হয়। তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে কেবল যোগ শিখিয়েছেন তাই নয়, একটি সুস্থ জীবনযাত্রার জন্য प्रेरितও করেছেন।
বৈশ্বিক মঞ্চে পতঞ্জলির প্রসার
পতঞ্জলির ফোকাস শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ এবং উপসাগরীয় দেশগুলিতেও এর পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। এখানে বসবাসকারী প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য পতঞ্জলি শুধু একটি বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয়ও বটে।
কোম্পানি তাদের বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজিতেও ভারতীয়ত্বকে কখনও ছাড়েনি। বিদেশেও এটিকে 'স্বদেশী' ব্র্যান্ড হিসেবেই প্রচার করা হয়েছে এবং এটাই একে বিশেষ করে তোলে।
নতুন যুগের দিকে এগিয়ে যাওয়া ব্র্যান্ড
আজ যখন বাজারে প্রতিযোগিতা চরমে, পতঞ্জলি নিজেকে শুধু একটি ব্র্যান্ড হিসেবে নয়, বরং একটি আন্দোলনের মতো প্রতিষ্ঠা করেছে। এই আন্দোলন হল – ভারতকে আত্মনির্ভর করার, মানুষকে প্রাকৃতিক এবং সুস্থ জীবনের দিকে নিয়ে যাওয়ার এবং ভারতীয় সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার।