ভারতের ইতিহাস বীরত্ব, পরাক্রম এবং আত্মত্যাগের অসংখ্য গাথা দিয়ে পরিপূর্ণ। এই অমর নামগুলির মধ্যে অন্যতম হলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান – যিনি পৃথ্বীরাজ তৃতীয় নামেও পরিচিত। চৌহান বংশের এই মহান যোদ্ধা, যিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে সিংহাসন গ্রহণ করে যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তা আজও ভারতীয়দের মনে অমর হয়ে আছে। পৃথ্বীরাজ চৌহান কেবল একজন যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এমন একজন শাসক যিনি ভারতের সংস্কৃতি, স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন: আজমীর থেকে দিল্লী পর্যন্ত যাত্রা
পৃথ্বীরাজের জন্ম ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে গুজরাটে হয়েছিল। তাঁর পিতা সোমেশ্বর চৌহান এবং মাতা কর্পূরাদেবী ছিলেন। সেই সময়ে চৌহান বংশের রাজধানী ছিল অজয়মেরু (আধুনিক আজমীর)। পৃথ্বীরাজের লালন-পালন চালুক্য দরবারে হয়েছিল, যেখানে তিনি রাজনীতি, যুদ্ধকলা, সাহিত্য এবং শাস্ত্রের শিক্ষা লাভ করেন। ১১৭৭ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১১ বছর বয়সে পৃথ্বীরাজকে সিংহাসনে বসানো হয়। নাবালক হলেও তিনি তাঁর মায়ের সাথে শাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং দ্রুত একজন যোগ্য শাসক হিসেবে পরিচিত হন।
শাসনকাল: বিস্তার, যুদ্ধ এবং রাজনীতির স্বর্ণযুগ
১১৭৮ থেকে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর শাসনকালে পৃথ্বীরাজ চৌহান উত্তর-পশ্চিম ভারতে চৌহান সাম্রাজ্যকে সুসংহত করেন। তাঁর অধীনে বর্তমান রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লী এবং মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ ছিল। পৃথ্বীরাজ একজন রণকৌশলী, ন্যায়পরায়ণ এবং ধর্মপ্রাণ রাজা ছিলেন। তিনি শুধু তাঁর রাজ্যের বিস্তার করেননি, বরং অনেক হিন্দু রাজাদের একত্রিত করে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
যুদ্ধকৌশল এবং প্রাথমিক বিজয়
পৃথ্বীরাজ চৌহান তাঁর শাসনকালে অনেক যুদ্ধ জয় করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় জয়গুলির মধ্যে একটি ছিল চান্দেল রাজা পরমর্দিরদেবের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধের পর তিনি বুন্দেলখণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে নিজের অধিকার স্থাপন করেন। এটি তাঁর সামরিক শক্তি এবং কৌশলের গভীরতা প্রকাশ করে। পৃথ্বীরাজ শুধু চান্দেলদের পরাজিত করেননি, পাশাপাশি আশেপাশের অনেক রাজা ও আক্রমণকারীদেরও পরাস্ত করেছিলেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীতে অশ্বারোহী, তীরন্দাজ এবং তরোয়াল চালনায় দক্ষ যোদ্ধারা ছিলেন, যারা সবসময় বিজয় এনে দিতেন। তাঁর সাহস এবং নেতৃত্ব তাঁকে একজন মহান যোদ্ধা করে তুলেছিল।
মোহাম্মদ ঘোরীর সাথে সংঘর্ষ: ভারতের ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধ
১. তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (১১৯১ খ্রি.)
মোহাম্মদ ঘোরী ১১৯১ সালে বাঠিন্দা (তাবারহিন্দ) দখল করেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান তাঁর মিত্রদের সাথে মিলিত হয়ে তরাইনের ময়দানে ঘোরীর বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে ঘোরী আহত হন এবং কোনোরকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে যান। এই বিজয়ে পৃথ্বীরাজ ভারতীয় উপমহাদেশে একজন মহান যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
২. তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১১৯২ খ্রি.)
যদিও ঘোরী এক বছর পর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরও শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করেন। এবার হিন্দু রাজাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার অভাব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং কিছু ভুলের কারণে পৃথ্বীরাজকে পরাজয় বরণ করতে হয়। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে পরাজয়ের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী শাসনের প্রবেশদ্বার উন্মোচিত হয়।
পৃথ্বীরাজের মৃত্যু এবং রহস্যময় কাহিনী
ঐতিহাসিকদের মতে, পরাজয়ের পর পৃথ্বীরাজকে বন্দী করে ঘোরীর দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু মুসলিম ঐতিহাসিক সূত্রানুসারে, পরে তাঁকে হত্যা করা হয়, আবার কিছু লোককথায় বর্ণিত আছে যে ঘোরী তাঁকে ক্ষমা করে পুনরায় রাজা নিযুক্ত করেন, কিন্তু বিদ্রোহের পর তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত কিংবদন্তি ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’ থেকে জানা যায়, কবি চন্দবরदाई গজনীতে গিয়ে পৃথ্বীরাজকে ঘোরীর শব্দ শুনে তীর ছুঁড়তে সাহায্য করেন এবং অবশেষে পৃথ্বীরাজ অন্ধ অবস্থায়ও ঘোরীকে হত্যা করেন। এই কাহিনী ঐতিহাসিক দিক থেকে সঠিক নয়, তবে জনসাধারণের মধ্যে এটি খুবই জনপ্রিয়।
সাহিত্যে চিত্র: বীরত্বের অমর গাথা
পৃথ্বীরাজ চৌহানকে নিয়ে অনেক কাব্যগ্রন্থ লেখা হয়েছে।
- পৃথ্বীরাজ বিজয়: এটি একমাত্র গ্রন্থ যা তাঁর শাসনকালে লেখা হয়েছিল।
- পৃথ্বীরাজ রাসো: চন্দবরদাই রচিত এই গ্রন্থটি তাঁকে একজন মহান রাজপুত যোদ্ধা হিসেবে চিত্রিত করে।
- প্রবন্ধ চিন্তামণি, হাম্মীর মহাকাব্য, আলহা-খণ্ড ইত্যাদিতেও পৃথ্বীরাজের যুদ্ধ এবং জীবনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
যদিও এগুলিতে অতিশয়োক্তি রয়েছে, তবুও এই রচনাগুলি পৃথ্বীরাজকে জনগণের নায়ক করে তুলেছে।
ঐতিহ্য এবং আধুনিক যুগে স্মৃতি
পৃথ্বীরাজ চৌহানকে আজও ‘শেষ হিন্দু সম্রাট’ হিসেবে স্মরণ করা হয়, যদিও এটি ঐতিহাসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ সঠিক নয়, কারণ তাঁর পরেও দক্ষিণ ভারত এবং পূর্ব ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্য টিকে ছিল। আজমীর ও দিল্লীতে পৃথ্বীরাজের স্মরণে অনেক স্মৃতিস্তম্ভ বিদ্যমান। দিল্লীর কিল্লা রাই পিথোরা তাঁর সাথে সম্পর্কিত। ভারতে অনেক বিদ্যালয়, রাস্তা এবং প্রতিষ্ঠানের নামও পৃথ্বীরাজ চৌহানের নামে রাখা হয়েছে।
সিনেমা ও টেলিভিশনে চিত্র
পৃথ্বীরাজ চৌহানের জীবন অবলম্বনে বেশ কয়েকটি সিনেমা ও টিভি ধারাবাহিক তৈরি হয়েছে, যেখানে তাঁর সাহস এবং বীরত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। 'ধরতি কা বীর যোদ্ধা পৃথ্বীরাজ চৌহান' নামক ধারাবাহিকে (২০০৬–২০০৯) তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে যুদ্ধ পর্যন্ত, তাঁর জীবনের গল্প খুবই আকর্ষণীয়ভাবে দেখানো হয়েছে। এছাড়াও, ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে অক্ষয় কুমার তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যেখানে তাঁর জীবন, মোহাম্মদ ঘোরীর সাথে যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগকে বড় পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে। এই মাধ্যমগুলি পৃথ্বীরাজ চৌহানকে আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে একজন সত্যিকারের নায়ক এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
পৃথ্বীরাজ চৌহান ভারতীয় ইতিহাসের সেই বীর যোদ্ধাদের মধ্যে একজন, যিনি সাহস, নেতৃত্ব এবং আত্মত্যাগের উদাহরণ তৈরি করেছেন। তাঁর বীরত্ব আজও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছে। তাঁর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে কঠিন সময়েও নিজের ধর্ম, দেশ এবং সম্মানেরক্ষার জন্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।