রাশিয়ার ন্যাপথা: ভারতের নতুন কেমিক্যাল উৎস

রাশিয়ার ন্যাপথা: ভারতের নতুন কেমিক্যাল উৎস

রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে জ্বালানি বাণিজ্য এখন শুধু অপরিশোধিত তেল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। এখন এতে একটি নতুন নাম যুক্ত হয়েছে, সেটি হল ন্যাপথা। ২০২৫ সালের জুনে ভারত রাশিয়া থেকে প্রায় ২.৫ লক্ষ টন ন্যাপথা আমদানি করেছে, যা থেকে এটা স্পষ্ট যে রাশিয়া এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কেমিক্যাল সরবরাহকারী হয়ে উঠছে।

পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় এই কেমিক্যাল আগে ভারত সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে কিনত, কিন্তু রাশিয়া থেকে সস্তায় পাওয়ায় ভারত এখন তাদের আমদানির উৎস পরিবর্তন করেছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ভারতের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ খুলে দিয়েছে, যা সরকার এবং কোম্পানিগুলো ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে।

ন্যাপথা কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ

ন্যাপথা একটি হালকা হাইড্রোকার্বন তরল, যা পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এটি থেকে ওলেফিন্স এবং অ্যারোমেটিক্সের মতো পণ্য তৈরি হয়, যা প্লাস্টিক, সিনথেটিক ফাইবার, রাবার, রেজিন, ডিটারজেন্ট এবং অন্যান্য কেমিক্যাল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ভারতে পেট্রোকেমিক্যালসের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে, এমন পরিস্থিতিতে ন্যাপথা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হিসেবে উঠে এসেছে। আগে এই ন্যাপথা পশ্চিম এশিয়া থেকে আসত, কিন্তু রাশিয়া থেকে পাওয়া সস্তা বিকল্প ভারতের জন্য খরচ কমানোর সুযোগ করে দিয়েছে।

জুনে ভারত রাশিয়া থেকে কত ন্যাপথা পেয়েছে

রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ সালের জুনে ভারত রাশিয়া থেকে প্রায় ২.৫ লক্ষ টন ন্যাপথা আমদানি করেছে। যদিও মে মাসের তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় ৫ শতাংশ কম ছিল, তবে পুরো ছয় মাসের চিত্র দেখলে এই সংখ্যাটি বেশ বড়।

জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ এর মধ্যে ভারত রাশিয়া থেকে ১৪ লক্ষ টনের বেশি ন্যাপথা আমদানি করেছে। এই চালানগুলো ভারতের পশ্চিম উপকূলের প্রধান বন্দর যেমন মুন্দ্রা, হাজিরা এবং সিক্কাতে পৌঁছেছে। এই বন্দরগুলো দেশের বড় রিফাইনারি এবং পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যুক্ত।

আগে ইউএই থেকে ন্যাপথা আসত, এখন রাশিয়া প্রধান সরবরাহকারী

এতদিন ভারত ইউএই থেকে প্রচুর পরিমাণে ন্যাপথা কিনত। কিন্তু রাশিয়া থেকে পাওয়া সস্তা ও স্থিতিশীল বিকল্প এখন কোম্পানিগুলোর জন্য বেশি লাভজনক প্রমাণিত হচ্ছে। এই কারণেই ভারত ইউএই থেকে আমদানি কমিয়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে।

এর পেছনে খরচ ছাড়াও লজিস্টিক কৌশলও জড়িত। রাশিয়া এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সরবরাহ বাড়িয়েছে, ফলে ভারত নিয়মিত এবং প্রচুর পরিমাণে চালান পাচ্ছে।

তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও তুরস্কও রুশ ন্যাপথার বড় ক্রেতা

ভারতের পাশাপাশি এশিয়ার অন্যান্য দেশও রাশিয়া থেকে ন্যাপথা কেনার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। তাইওয়ান জুনে ২.৩৪ লক্ষ টন ন্যাপথা রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে, যা মে মাসের তুলনায় দ্বিগুণ।

জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ এর মধ্যে তাইওয়ান ১২.৭ লক্ষ টন ন্যাপথা আমদানি করেছে। এছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং চীনও রুশ ন্যাপথার বড় আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছে। এতে স্পষ্ট যে রাশিয়া ইউরোপীয় বাজারের ক্ষতি এশিয়ার মাধ্যমে পুষিয়ে নিয়েছে।

ইউএই থেকে সরবরাহ কম, লোহিত সাগর হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক

যেখানে একদিকে ভারত এবং এশিয়া রাশিয়া থেকে ন্যাপথা কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে অন্যদিকে ইউএই তাদের কেনাকাটা কমিয়েছে। জুনে ফুজেরাহ বন্দরে রাশিয়া থেকে কোনো ন্যাপথা আসেনি, যেখানে মে মাসে সেখানে ৮০,০০০ টন পাঠানো হয়েছিল।

এর বড় কারণ হল লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের দ্বারা করা হামলা। এই কারণে ব্যবসায়ীরা এখন দক্ষিণ আফ্রিকার ‘কেপ অফ গুড হোপ’ রুট দিয়ে পণ্য পাঠাচ্ছে। জুনে এই রুটে প্রায় ৩ লক্ষ টন ন্যাপথা এশিয়াতে পৌঁছেছে, যেখানে মে মাসে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৫ লক্ষ টন।

ভারতের জন্য কৌশলগতও এই পদক্ষেপ

ভারত কর্তৃক রাশিয়া থেকে ন্যাপথা ক্রয় শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক বোঝাপড়া নয়, এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপও। একদিকে এটি শিল্পকে সস্তা দামে প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল সরবরাহ করছে, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার সময়ে একটি নির্ভরযোগ্য সরবরাহ চেইনও তৈরি হচ্ছে।

রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি সহযোগিতা ভারতের জন্য দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এখন এই সহযোগিতা অপরিশোধিত তেলের পাশাপাশি কেমিক্যাল সেক্টরেও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এতে শুধু ভারতের শিল্পই লাভবান হচ্ছে না, রাশিয়ার জন্যও এটি একটি নতুন এবং স্থায়ী বাজার হয়ে উঠছে।

Leave a comment