সম্রাট অশোক: ইতিহাস, ধর্ম এবং মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

সম্রাট অশোক: ইতিহাস, ধর্ম এবং মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

ভারতের ইতিহাসে সম্রাট অশোকের নাম শুধুমাত্র একজন শক্তিশালী শাসক হিসেবেই নয়, বরং এমন একজন রাজা হিসেবেও স্মরণ করা হয় যিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে শান্তি, করুণা ও ধর্মের পথ অবলম্বন করেছিলেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের এই চক্রবর্তী সম্রাট শুধু ভারতেই নয়, বরং সমগ্র এশিয়াতে বৌদ্ধ ধর্ম ও মানবিক মূল্যবোধের প্রচার করেছিলেন।

মৌর্য রাজবংশের পটভূমি

প্রায় ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মৌর্য বংশের সূচনা করেন। সেই সময় ভারতে অনেক ছোট ছোট রাজ্য ছিল, যাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত। চন্দ্রগুপ্ত তার গুরু চাণক্যের সাহায্যে এই রাজ্যগুলোকে একত্রিত করেন এবং একটি বড় সাম্রাজ্য তৈরি করেন, যার রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পর তার পুত্র বিন্দুসার শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সাম্রাজ্যকে স্থিতিশীল রাখেন এবং দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত এর বিস্তার ঘটান। বিন্দুসারের পর তার পুত্র অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের সিংহাসন লাভ করেন এবং এটিকে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন।

রাজগद्दी পর্যন্ত অশোকের সংগ্রাম

অশোককে মৌর্য সাম্রাজ্যের গद्दी সহজে পেতে হয়নি। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বলা হয়েছে যে তাকে নিজের ভাইদের সঙ্গেই লড়তে হয়েছিল। কিছু কাহিনি অনুসারে, অশোক ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তার অনেক ভাইকে পরাজিত বা হত্যা করেছিলেন, কিন্তু এই কথাটি সব গ্রন্থে একরকমভাবে পাওয়া যায় না। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে অশোক কেবল এক বা দুই জন ভাইয়ের সঙ্গেই লড়েছিলেন এবং বাকি ভাইদের শাসনকার্যে স্থান দিয়েছিলেন। কিছু শিলালিপি থেকে এও জানা যায় যে তার ভাইয়েরা পরবর্তীতে প্রশাসনে কাজ করছিলেন। এতে বোঝা যায় যে অশোক পুরোপুরি নির্দয় ছিলেন না, বরং পরিস্থিতির অনুসারে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন।

কলিঙ্গ যুদ্ধ: একটি বাঁক

অশোক যখন সম্রাট হন, তখন তিনি অন্যান্য শাসকদের মতো যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্য বিস্তারে বিশ্বাস করতেন। তিনি অনেক অঞ্চল জয় করেন এবং তার সাম্রাজ্যকে বড় করে তোলেন। কিন্তু যখন তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন, তখন যুদ্ধটা খুবই ভয়াবহ হয়। এতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যান এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হন, যা দেখে অশোক খুবই দুঃখ পান। কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি অনুভব করেন যে যুদ্ধ শুধু ধ্বংসই নিয়ে আসে, শান্তি নয়। এই যুদ্ধের পর অশোক হিংসা ত্যাগ করে শান্তি ও করুণার পথ অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং জীবনভর অহিংসা ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দেন।

ধর্ম বিজয়ের শুরু

কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়ানক পরিণতি সম্রাট অশোককে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন যে যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ গেছে এবং অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। এই দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর অশোক সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি আর হিংসা করবেন না এবং শান্তির পথ অনুসরণ করবেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের জীবনকে করুণা, অহিংসা ও সত্যের পথে চালানোর প্রতিজ্ঞা করেন। অশোক তার সাম্রাজ্যে 'ধম্ম' অর্থাৎ ধর্মের নীতিগুলি প্রচার করেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে পাথরের ওপর শিলালিপি খোদাই করান, যেখানে মানুষকে দয়া, ক্ষমা, সহনশীলতা এবং নৈতিক জীবন যাপনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। অশোক এও নিশ্চিত করেছিলেন যে সব ধর্মের প্রতি সম্মান জানানো হবে এবং মানুষে মানুষে যেন ভালোবাসা থাকে। তাঁর এই পরিবর্তন আজও ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়।

বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বব্যাপী বিস্তার

সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মকে শুধু ভারতেই নয়, বরং বিদেশের মাটিতেও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছিলেন। তিনি তার ছেলে মহেন্দ্র ও মেয়ে সংঘমিত্রাকে শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়েছিলেন, যাতে সেখানকার মানুষও বৌদ্ধ ধর্মকে বুঝতে পারে। তাঁর এই পদক্ষেপের ফলে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত হয় এবং সেখানকার মানুষ আজও এটি অনুসরণ করে। এছাড়াও অশোক তার ধর্ম প্রচারকদের সিরিয়া, মিশর ও গ্রিসের মতো দেশেও পাঠিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সারা বিশ্বে শান্তি, করুণা ও অহিংসার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। এভাবে অশোকের প্রচেষ্টায় বৌদ্ধ ধর্ম একটি আন্তর্জাতিক আদর্শে পরিণত হয়, যা আজও অনেক দেশ অনুসরণ করে।

অশোকের প্রশাসন: ধর্ম ও ন্যায়ের মিশ্রণ

সম্রাট অশোকের প্রশাসন ছিল খুবই ন্যায়পরায়ণ এবং ধর্মভিত্তিক। তিনি শাসনকার্যে এমন সব আধিকারিকদের নিযুক্ত করেছিলেন, যাদের 'ধম্ম মহামাত্র' বলা হত। এই আধিকারিকরা মানুষকে ভালো আচরণ, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং পারস্পরিক ভালোবাসার শিক্ষা দিতেন। অশোক চাইতেন প্রত্যেক মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে শান্তিতে জীবন কাটাক এবং ধর্মের পথে চলুক। অশোক তাঁর শাসনকালে সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতি খেয়াল রেখেছিলেন। তিনি কৃষকদের জন্য সেচের ব্যবস্থা করেছিলেন, ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন এবং মহিলাদের অধিকার রক্ষা করেছিলেন। তিনি পশু-পাখিদের রক্ষার জন্য আইন তৈরি করেছিলেন এবং বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল ও কূপ খনন করিয়েছিলেন। অশোকের শাসন ছিল ধর্ম, ন্যায় ও জনকল্যাণের এক अद्भुत उदाहरण।

স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভের ঐতিহ্য

সম্রাট অশোকের সবচেয়ে বিখ্যাত ঐতিহ্য হল তাঁর তৈরি করা শিলালিপি ও স্তম্ভগুলো। পাথরের ওপর খোদাই করা এই বার্তাগুলো আজও ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে দেখতে পাওয়া যায়। এই স্তম্ভগুলোর মধ্যে সারনাথের সিংহ স্তম্ভ সবচেয়ে বিখ্যাত, যাকে ভারত তার জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই স্তম্ভের উপরে চারটি সিংহের মূর্তি রয়েছে, যা সাহস, শক্তি ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই শিলালিপিগুলোতে অশোক মানুষকে ধর্ম, নৈতিকতা ও পারস্পরিক ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি জনসাধারণকে ঝগড়া না করতে, তাদের বাবা-মা ও গুরুজনদের সেবা করতে এবং সকল ধর্মের প্রতি সম্মান জানানোর কথা বলেছেন। এই বার্তাগুলো আজও আমাদের ভালো মানুষ হওয়ার প্রেরণা দেয় এবং অশোকের চিন্তাভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখে।

শেষকাল এবং উত্তরাধিকার

২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের মৃত্যু হয়, এবং তাঁর মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। তবে, অশোকের প্রভাব শুধুমাত্র তাঁর জীবনকালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি যে অহিংসা, ধর্ম, সহনশীলতা ও জনকল্যাণের নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ থেকে নেওয়া হয়েছে, এবং ভারতীয় সংবিধান ও পররাষ্ট্র নীতিতেও তাঁর চিন্তাভাবনার ছায়া দেখা যায়। অশোকের উত্তরাধিকার আজও আমাদের সমাজে নৈতিকতা ও মানবতার উদাহরণ হিসেবে বেঁচে আছে।

সম্রাট অশোকের জীবন আমাদের শেখায় যে একজন শক্তিশালী শাসকও করুণা, অহিংসা ও ধর্মের পথে হেঁটে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারেন। তাঁর নীতিগুলো আজও সমাজ, রাজনীতি ও মানবতার জন্য অনুপ্রেরণা। অশোক প্রমাণ করেছিলেন যে প্রকৃত রাজা তিনিই যিনি তাঁর প্রজাদের সুখ-দুঃখ বোঝেন এবং তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করেন।

Leave a comment