শ্রাবণ মাস শুরু হতেই মন্দিরগুলোতে হর হর মহাদেবের জয়ধ্বনি শোনা যায়। এই মাসটি সম্পূর্ণরূপে ভগবান শিবকে উৎসর্গীকৃত বলে মনে করা হয়। এই কারণে, এই মাসে শিবভক্তরা বিশেষভাবে ব্রত, জলাভিষেক ও ভক্তির মাধ্যমে শিবকে প্রসন্ন করার চেষ্টা করেন। এর পাশাপাশি আরও একটি ঐতিহ্য রয়েছে, যা ধীরে ধীরে আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে – বাড়িতে শমী গাছ লাগানো। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই গাছ শিব ঠাকুরের পাশাপাশি শনিদেবেরও অত্যন্ত প্রিয়।
শমী গাছের ধর্মীয় গুরুত্ব কী
পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে শমী গাছের উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়। এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে, রামায়ণ কালে ভগবান শ্রীরামও শমী গাছের পূজা করেছিলেন। মহাভারতে অর্জুনও তাঁর অস্ত্রশস্ত্র এই গাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই কারণে শমী গাছকে শক্তি, বিজয় ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
শিবপুরাণ অনুযায়ী, শমী গাছ নেতিবাচক শক্তি দূর করে এবং বাড়িতে ইতিবাচকতা নিয়ে আসে। অন্যদিকে, জ্যোতিষশাস্ত্রে এটিকে শনিদেবের শান্তির জন্য অত্যন্ত উপযোগী বলে মনে করা হয়।
শনির দোষে পাওয়া যায় মুক্তি
যদি কোনও ব্যক্তির কোষ্ঠীতে শনির সাড়েসাতি বা ঢাইয়া চলে, তাহলে শমী গাছ লাগালে তার প্রভাব কম হতে পারে। শনিকে প্রসন্ন করার জন্য এই গাছের পূজা করার রীতি প্রচলিত আছে। শাস্ত্রে লেখা আছে যে, শমী গাছের গোড়ায় সরষের তেলের প্রদীপ জ্বালালে শনিদেবের কুদৃষ্টি দূর হয়।
শমী পাতা ভগবান শিবকেও নিবেদন করা হয়, যার ফলে শিবভক্তরা বিশেষ লাভবান হন বলে মনে করা হয়।
শ্রাবণে লাগালে কেন আরও বেশি ফলদায়ক হয়
শ্রাবণ মাস শিবের আরাধনার জন্য সবচেয়ে শুভ সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই মাসে যে কোনও ধার্মিক কাজের প্রভাব দ্রুত এবং গভীর হয় বলে মনে করা হয়। এই সময় শমী গাছ লাগালে শিব ও শনি, উভয়ের কৃপা একসঙ্গে পাওয়া যায়। বিশ্বাস করা হয় যে, শ্রাবণে শমী গাছের নিয়মিত পূজা করলে বাড়িতে শান্তি বজায় থাকে, মনে স্থিরতা আসে এবং অনেক প্রকার মানসিক চাপ দূর হতে পারে।
শমী গাছ কোথায় লাগাবেন এবং কীভাবে পূজা করবেন
শাস্ত্র অনুযায়ী, শমী গাছ কখনওই বাড়ির ভেতরে লাগানো উচিত নয়। এটি সবসময় বাড়ির বাইরে, যেমন – ছাদ, বারান্দা বা বাগানে লাগানো উচিত। বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, দক্ষিণ দিকে এই গাছ লাগানো সবচেয়ে ভালো। এছাড়া পূর্ব দিক বা ঈশান কোণ অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিকও উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।
গাছ লাগানোর সময় কিছু ঐতিহ্যপূর্ণ নিয়ম পালন করার কথা বলা হয়। যেমন – শমী গাছের গোড়ায় একটি সুপারি ও মুদ্রা চাপা দেওয়ার রীতি আছে। এছাড়াও, এটা মনে রাখতে হবে যে, এই গাছে যেন সরাসরি রোদ না লাগে এবং প্রতিদিন সামান্য জল দিতে হবে।
শমী পাতা দিয়ে হয় বিশেষ পূজন
শিবলিঙ্গে বেল পাতার সঙ্গে শমী পাতাও খুব প্রিয় বলে মনে করা হয়। শ্রাবণ মাসের সোমবারে এই পাতা নিবেদন করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়। বিশেষ বিষয় হল, এই পাতা নিবেদনের সময় 'ওঁ নমঃ শিবায়' মন্ত্র উচ্চারণ করলে সেই পূজা আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
শমী পূজায় পাওয়া যায় সংযম ও শান্তির অনুভূতি
শমী গাছ শুধু ধার্মিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, মানসিক দিক থেকেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর সবুজ রঙ মনকে শান্তি দেয় এবং এর পূজার মাধ্যমে জীবনে শৃঙ্খলা ও সংযম আসে।
এই কারণে অনেক সাধক, যোগী ও ভক্ত এই গাছের ছায়ায় বসে ধ্যানও করেন। এটা মনে করা হয় যে, এর ফলে নেতিবাচক চিন্তা কমে যায় এবং সাধনায় মন আরও বেশি লাগে।
শ্রাবণে শ্রদ্ধা ও শমীর মিলন
যখন শ্রাবণের বৃষ্টি এবং পরিবেশের শুদ্ধতার মধ্যে কোনও ভক্ত শমী গাছ লাগান, তখন এটি শুধু একটি গাছ থাকে না, বরং সেটি তাঁর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠে।
প্রতি শনিবার সেই গাছের সামনে প্রদীপ জ্বালানো, তার পাতা দিয়ে শিবের পূজা করা এবং তার উপর বিশ্বাস রাখা – এই সবকিছু শিবভক্তদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।
শিব ও শনির কৃপা পাওয়ার মাধ্যম
শমী গাছ দুটি দেবতার মধ্যে একটি বিশেষ সেতুর মতো – একদিকে শিব, যিনি করুণা ও মোক্ষের প্রতীক, এবং অন্যদিকে শনি, যিনি ন্যায় ও কর্মফলের প্রতীক। যখন কোনও ভক্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই গাছের সেবা করেন, তখন তিনি দুজনেরই কৃপা লাভ করেন।