টাটা গ্রুপের প্রধান হোল্ডিং কোম্পানি টাটা সন্সকে নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে যে এই বৃহৎ কোম্পানিটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারবে কিনা। বর্তমানের ইঙ্গিত অনুযায়ী, টাটা সন্সের পক্ষ থেকে আইপিও (IPO) আনার কোনো সক্রিয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে না। এর সবচেয়ে বড় কারণ হল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম, যা বর্তমানে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
আরবিআই-এর কড়াকড়িই তালিকাভুক্তির কারণ
২০২২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক টাটা সন্সকে ‘আপার লেয়ার’ নন-ব্যাংকিং ফিনান্স কোম্পানি (NBFC-UL) শ্রেণীতে রেখেছিল। এই শ্রেণীতে আসা কোম্পানিগুলির জন্য নিয়ম অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে পাবলিক তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এর মানে হল টাটা সন্সকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে।
তবে, টাটা সন্সের প্রকৃতি এমন যে এটি সরাসরি সাধারণ গ্রাহকদের সাথে জড়িত আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা নয়। এর প্রধান কাজ হল টাটা গ্রুপের কোম্পানিগুলিতে বিনিয়োগ করা এবং সেগুলির পরিচালনা করা। এই কারণেই টাটা সন্স আরবিআই-এর কাছে আবেদন করেছিল, যাতে তাদের কোর ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি (CIC) হিসেবেই বহাল রাখা হয় এবং ‘আপার লেয়ার’-এর শর্ত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
আইপিও-র কোনো পরিকল্পনা নেই
সূত্রের খবর অনুযায়ী, টাটা সন্স বর্তমানে শেয়ার বাজারে আসার কোনো পরিকল্পনা করছে না। কোম্পানির বিশ্বাস, আরবিআই তাদের সময়সীমা বাড়ানোর অনুমতি দেবে। এর জন্য গত বছর থেকেই টাটা সন্স কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে এবং তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
যদি আরবিআই তালিকাভুক্তির সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে থাকে অথবা টাটা সন্সকে সিআইসি হিসাবে পুনরায় স্বীকৃতি দেয়, তবে কোম্পানিটি বাজারে আসার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
টাটা ট্রাস্টের নিয়ন্ত্রণ এবং কাঠামোর প্রশ্ন
টাটা সন্সের ৬৬ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ টাটা ট্রাস্টের হাতে। এছাড়াও, এই কোম্পানিটি টিসিএস, টাটা মোটরস, টাইটান, টাটা পাওয়ার, টাটা স্টিলের মতো অনেক বড় কোম্পানিতে অংশীদারিত্ব রাখে। এই হোল্ডিং কাঠামো কোম্পানিকে কৌশলগতভাবে শক্তিশালী করে।
যদি টাটা সন্স শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়, তবে তাদের আর্থিক অবস্থা, শেয়ারহোল্ডিং কাঠামো এবং কৌশলগুলির স্বচ্ছতা প্রকাশ্যে আসবে। এতে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হতে পারলেও, কোম্পানিকে বাইরের অধিগ্রহণ বা টেকওভারের সম্ভাবনা মোকাবিলা করতে হতে পারে।
বর্তমানে, টাটা সন্স একটি বেসরকারি কোম্পানি এবং এর পরিচালকরা যেকোনো অবাঞ্ছিত অধিগ্রহণের চেষ্টা সরাসরি আটকাতে পারেন। কিন্তু যদি এই কোম্পানি পাবলিক হয়ে যায়, তবে এই ধরনের প্রচেষ্টা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে না।
শাপুরজি পালনজি গ্রুপের ক্ষতি হতে পারে
টাটা সন্সের তালিকাভুক্তিতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী পক্ষ হল শাপুরজি পালনজি গ্রুপ। এই গ্রুপের টাটা সন্সের প্রায় ১৮.৩৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ঋণে জর্জরিত এই গ্রুপটি তাদের শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহের পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু তালিকাভুক্তি পিছিয়ে গেলে তারা বড় ধাক্কা খেতে পারে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, টাটা সন্সের আইপিও শাপুরজি পালনজি গ্রুপকে তাদের অংশীদারিত্ব বিক্রি করার একটি ভালো সুযোগ দিতে পারত, কারণ শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু প্রকাশ্যে আসত। কিন্তু এখন গ্রুপটিকে তাদের পরিকল্পনা স্থগিত করতে হতে পারে।
সরকার ও আরবিআই-এর সিদ্ধান্তের দিকে নজর
এখন দেখার বিষয় হল, আরবিআই টাটা সন্সের দাবিতে কী পদক্ষেপ নেয়। সম্প্রতি, অর্থ সচিব সঞ্জয় মালহোত্রা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এনবিএফসি সংস্থাগুলির জন্য নিয়মগুলি পর্যালোচনা করা হচ্ছে এবং সময়ের সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন করা হতে পারে। তাঁর মতে, "নীতিগুলিকে বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা জরুরি এবং সেক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেওয়া হতে পারে।"
আরবিআই-এর পর্যালোচনা প্রক্রিয়া এখনও চলছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। তবে সূত্রের খবর, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
গত বছরগুলোতে কী ঘটেছে
টাটা সন্সের তালিকাভুক্তির আলোচনা প্রথমবার জোরদার হয়েছিল যখন কোম্পানিটিকে এনবিএফসি-ইউএল শ্রেণীতে রাখা হয়েছিল। তারপর থেকে এই প্রশ্ন ক্রমাগত উঠছে যে এত বড় কর্পোরেট গ্রুপের হোল্ডিং কোম্পানির কি পাবলিক হওয়া উচিত নাকি নয়।
২০২৩ এবং ২০২৪ সালে কোম্পানির পক্ষ থেকে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা দেখে মনে হয় তারা আইপিও-র দিকে এগোচ্ছে। না কোনো ব্যাঙ্কার নিয়োগ করা হয়েছে, না কোনো প্রাথমিক কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে।
বাজারের প্রতিক্রিয়া ও পর্যবেক্ষণ
শেয়ার বাজারে টাটা সন্সের সম্ভাব্য তালিকাভুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, এই তালিকাভুক্তি টাটা গ্রুপের স্বচ্ছতা বাড়াবে এবং বিনিয়োগকারীরা আরও ভালো তথ্য পাবে। আবার কেউ কেউ এটিকে একটি ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন, বিশেষ করে যখন অধিগ্রহণ এবং শেয়ারহোল্ডিং নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ আসে।
আরবিআই-এর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বাজারের অনেক বড় খেলোয়াড়ও, যারা জানতে চায় যে ভারতের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট হোল্ডিং কোম্পানি শেষ পর্যন্ত পাবলিক হবে কিনা।