প্রায়শই যখন ব্রতের কথা ওঠে, তখন মানুষের মনে প্রথমেই আসে যে আজ তো উপোস থাকতে হবে, জলও পান করা যাবে না, বা শুধু ফল খেয়ে দিন কাটাতে হবে। কিন্তু এটাই কি উপবাস? ব্রতের অর্থ কি কেবল উপোস থাকা, নীরব থাকা বা নিজের দৈনন্দিন রুটিন পরিবর্তন করা? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শ্রী পঞ্চায়েতী আখড়া নিরঞ্জনীর মহন্ত স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি।
উপবাসের মানে ভগবানের কাছাকাছি থাকা
স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির মতে, উপবাসের অর্থ কেবল খাবার না খাওয়া নয়। তিনি জানান, উপবাস শব্দটি দুটি অংশ নিয়ে গঠিত - 'উপ' এবং 'বাস'। 'উপ'-এর অর্থ হল ভগবানের কাছে এবং 'বাস'-এর মানে হল থাকা। অর্থাৎ ব্রতের দিনে ব্যক্তির মন, বুদ্ধি এবং চিত্ত সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের প্রতি একাগ্র হওয়া উচিত।
শরীর থেকে নয়, মন থেকে উপবাস হওয়া উচিত
স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি বলেন, কেবল শরীরকে উপোস রাখা ব্রত নয়। আসল উপবাস তখন হয় যখন মানুষ নিজের মনকে সাংসারিক জিনিস থেকে সরিয়ে ভগবানের দিকে লাগায়। সেই দিন ঈশ্বরের স্মরণে সময় কাটানো, তাঁর ধ্যান করা, জপ-তপ করা এবং মনকে একাগ্র করাই হল প্রকৃত ব্রত।
ব্রতে ভোগ নিবেদন করাও জরুরি
স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি জানান যে ব্রতের দিনে নিজের ইষ্টদেবতাকে প্রসন্ন করার জন্য তাঁর অনুসারে ভোগ নিবেদন করা উচিত। যেমন - ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তুলসী পাতা, শিবজিকে বেল পাতা, মাতাকে লবঙ্গ, গণেশজিকে দূর্বা পাতা ভোগে অবশ্যই দিতে হবে। এর পরে সেই প্রসাদ শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।
মন্ত্র জপ ও ধ্যান হল ব্রতের আত্মা
তিনি বলেন যে উপবাসের দিনে 108 বার নিজের ইষ্টদেবের মন্ত্র জপ করা অত্যন্ত ফলদায়ক বলে মনে করা হয়। এই জপ মনকে একাগ্র করে এবং আমাদের ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে তোলে। পাশাপাশি ব্রতে করা ধ্যান ও পূজার মাধ্যমে মনের শুদ্ধি হয়, যা ব্রতের প্রধান উদ্দেশ্য।
ব্রত একটি সাধনার প্রক্রিয়া
স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি উপবাসকে সাধনার একটি রূপ বলেছেন। তাঁর বক্তব্য হল, এই সাধনা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের দিকে নিয়ে যায়। উপবাসের মাধ্যমে মনকে শান্ত করা যায়, ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ পাওয়া যায় এবং আত্মিক শুদ্ধি লাভ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ভেতরে তাকাতে পারে এবং নিজেকে সংশোধন করতে পারে।
অন্য ধর্মেও উপবাসের গুরুত্ব রয়েছে
স্বামীজি জানান যে শুধু হিন্দু ধর্মে নয়, বরং ইসলাম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মেও উপবাসের গুরুত্ব রয়েছে। রমজান মাসে মুসলমানরা রোজা রাখেন, যেখানে তাঁরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কিছু খান না। খ্রিস্টান ধর্মেও লেন্টের সময় উপবাস করা হয়। এই সবই আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও ঈশ্বর ভক্তির দিকে ইঙ্গিত করে।
সত্যিকারের ব্রত সেটাই যা চিন্তাভাবনাকে শুদ্ধ করে
স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি বলেন যে ব্রতের আসল উদ্দেশ্য শরীরকে কষ্ট দেওয়া নয়, বরং মন ও চিন্তাভাবনাকে শুদ্ধ করা। যদি কোনও ব্যক্তি দিনভর উপোস থেকেও মনে নেতিবাচকতা, ক্রোধ, অহংকার ও লোভ পুষে রাখে, তাহলে তার ব্রত ব্যর্থ। অন্যদিকে যে ব্যক্তি নিজের চিন্তাভাবনাকে পবিত্র রাখে, অভাবীদের সাহায্য করে এবং দিনভর ভক্তিভাবে মগ্ন থাকে, সেই প্রকৃত অর্থে উপবাস করছে।
শুধু পানাহার নয়, ব্যবহারও সংযত হওয়া উচিত
স্বামীজি বলেন যে উপবাস শুধু পানাহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। ব্যক্তিকে নিজের ব্যবহারে সংযম আনা উচিত। কথার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা, মিথ্যা কথা না বলা, কারও নিন্দা না করা এবং সকলের প্রতি প্রেমের ভাব রাখা উপবাসের একটি অংশ।
ব্রতের সঙ্গে জড়িত বিশ্বাসগুলোকে বোঝা জরুরি
আজকাল অনেক মানুষ ব্রত তো রাখে কিন্তু তার অর্থ বোঝে না। শুধু ঐতিহ্যের নামে উপোস থেকে যায় বা ফলাহার করে, কিন্তু তাদের মন ভক্তির সঙ্গে যুক্ত হয় না। স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি বলেন যে এমন অবস্থায় ব্রতের আসল ফল পাওয়া যায় না। তাই জরুরি হল উপবাসের পেছনে লুকানো উদ্দেশ্যকে বোঝা এবং সেই অনুযায়ী তা গ্রহণ করা।
স্বামী কৈলাশানন্দ গিরির বার্তা
স্বামী কৈলাশানন্দ গিরি উপবাসকে একটি আত্মিক যাত্রার অংশ বলেছেন। তাঁর বক্তব্য হল যখন আমরা নিজেদের মন ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি, তখন আমরা প্রকৃত উপবাসী হই। উপবাসের দিনটিকে ভগবানের নামে কাটান, তাঁর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করুন এবং নিজের মনকে নির্মল করুন। এটাই উপবাসের সঠিক উপায়।