আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশে ম্যানুফ্যাকচারিংকে (উৎপাদন) উৎসাহিত করার কথা বলছেন। যদিও, বেশি লেবার খরচ (শ্রমিক মজুরি), দক্ষতার অভাব এবং জটিল সাপ্লাই চেন (সরবরাহ শৃঙ্খল) এর মতো সমস্যাগুলো এই পথে বড় চ্যালেঞ্জ।
US Manufacturing Issue: ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তিনি "Make America Great Again" এই স্লোগান দিয়ে দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরকে (উৎপাদন ক্ষেত্র) পুনরায় তৈরি করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ট্রাম্পের নীতির মূল উদ্দেশ্য হল আমেরিকাকে আবার উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এই পথে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা এই স্বপ্নকে বাস্তব হতে বাধা দিচ্ছে। আসুন জেনে নেই, আমেরিকা'র ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর কোন প্রধান সমস্যাগুলোর সাথে লড়াই করছে।
আমেরিকার ম্যানুফ্যাকচারিং নীতির উদ্দেশ্য
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির লক্ষ্য হল, আমেরিকান কোম্পানিগুলো দেশের ভেতরে উৎপাদন করবে, বিদেশি আমদানির উপর নির্ভরতা কমবে এবং দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। এর জন্য তিনি চীন সহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির উপর ট্যাক্স (কর) বাড়িয়েছেন, যাতে বিদেশি জিনিসপত্রগুলো দামি হয় এবং আমেরিকান জিনিস উৎসাহিত হয়। এই নীতি বাণিজ্যিক ভারসাম্য (ট্রেড ব্যালেন্স) सुधारের (উন্নতির) দিকে একটা পদক্ষেপ ছিল। যদিও এর প্রভাব মিশ্র ছিল।
এখনও কি আমেরিকা'র ম্যানুফ্যাকচারিং শক্তিশালী?
আমেরিকার ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর এখনও প্রযুক্তি, উদ্ভাবন (ইনোভেশন) এবং উচ্চ গুণগত মানের দিক থেকে বিশ্বের প্রথম সারির ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সস্তা উৎপাদনের জন্য চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সাথে পাল্লা দেওয়া সহজ নয়। তাই এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ যে, আমেরিকাতে উৎপাদনকে ফিরিয়ে আনা কি বাস্তবসম্মত, নাকি শুধু একটি রাজনৈতিক স্লোগান।
আমেরিকান ম্যানুফ্যাকচারিংকে যে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো পিছিয়ে দিচ্ছে
১. বেশি লেবার খরচ
আমেরিকাতে শ্রমিকদের মজুরি অনেক বেশি। একজন ফ্যাক্টরি কর্মীর গড় মজুরি ভারত বা চীনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এর ফলে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়। এটাই কারণ যে, অনেক কোম্পানি আমেরিকাতে ইউনিট স্থাপনের পরিবর্তে বিদেশে কম খরচে প্রোডাকশন (উৎপাদন) করানো ভালো মনে করে।
২. দক্ষ কর্মী (স্কিলড ওয়ার্কফোর্স) এর অভাব
আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারিং অটোমেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এবং উচ্চ প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। এর জন্য বিশেষ ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন। কিন্তু আমেরিকাতে এই ধরনের দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিকের খুব অভাব। বিগত দশকগুলোতে টেকনিক্যাল ট্রেনিংয়ের (কারিগরি প্রশিক্ষণ) উপর কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, যে কারণে ইন্ডাস্ট্রি (শিল্প) দক্ষ মানব সম্পদ পাচ্ছে না। এই স্কিল গ্যাপ (দক্ষতার পার্থক্য) উৎপাদনকে ধীর করে দিচ্ছে।
৩. জটিল সাপ্লাই চেন সিস্টেম
গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং (বৈশ্বিক উৎপাদন) এখন সাপ্লাই চেনের উপর নির্ভরশীল। আমেরিকার শিল্পও কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশের জন্য চীন এবং অন্যান্য দেশের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই সাপ্লাই চেন বেশ অস্থির। মহামারী, যুদ্ধ, ট্রেড ওয়ার (বাণিজ্য যুদ্ধ) বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাপ্লাইকে ব্যাহত করতে পারে। এতে খরচ বাড়ে এবং উৎপাদনের গতি কমে যায়।
৪. ইনফ্রাস্ট্রাকচারের (অবকাঠামো) পুরনো অবস্থা
যদিও আমেরিকার একটি শক্তিশালী ট্রান্সপোর্ট (পরিবহন) নেটওয়ার্ক রয়েছে, তবুও কিছু অঞ্চলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার আপগ্রেড (শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন)-এর প্রয়োজন। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং মিডওয়েস্টার্ন (মধ্য-পশ্চিম) এলাকাগুলোতে, যেখানে ফ্যাক্টরি স্থাপন করা যেতে পারে, সেখানে রাস্তা, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেটের গুণগত মানের উন্নতি দরকার।
৫. পরিবেশ ও শ্রম আইনের কড়াকড়ি
আমেরিকাতে পরিবেশ সুরক্ষা এবং শ্রমিক অধিকার সম্পর্কিত নিয়ম বেশ কঠোর। এই নিয়মগুলো জরুরিও, কিন্তু এর ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং খরচ বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো প্রোডাক্ট (পণ্য) তৈরি করার জন্য যে মেশিনগুলোর প্রয়োজন হয়, সেগুলো আমেরিকাতে হাই স্ট্যান্ডার্ডের (উচ্চ মানের) হয়ে থাকে, যেখানে অন্যান্য দেশে এই কাজগুলো কম খরচে করা যেতে পারে।
৬. গ্রাহকদের অভ্যাসের পরিবর্তন
আমেরিকান গ্রাহকদের অভ্যাসও উৎপাদন খরচকে প্রভাবিত করে। তারা কম দামে বেশি বিকল্প চায়, এবং বিদেশি জিনিসপত্রের গুণগত মানের উপর সন্তুষ্ট। যতক্ষণ না আমেরিকাতে তৈরি জিনিসের দাম বিশ্ব বাজারের সাথে মেলে, ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রাহকরা দেশীয় জিনিস কিনতে আগ্রহী হবে না।
তবুও কেন ট্রাম্প জোর দিচ্ছেন?
ট্রাম্পের বিশ্বাস, আমেরিকাকে আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য নিজেদের পণ্য নিজেদেরকেই তৈরি করতে হবে। তাঁর যুক্তি হল, এতে দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান বাড়বে, বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং বিদেশি নির্ভরতা কম হবে। একই সাথে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি জিনিসগুলো দেশে তৈরি করা দরকার।
কি পথ বের হতে পারে?
যদিও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সমাধানও আছে। আমেরিকা যদি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিংকে উৎসাহিত করে, স্কিল ডেভেলপমেন্টে (দক্ষতা উন্নয়ন) বিনিয়োগ করে এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে আপগ্রেড করে, তাহলে উৎপাদনের খরচ কমতে পারে। এছাড়াও, সরকারকে নতুন শিল্প স্থাপনকারীদের ট্যাক্স ছাড় এবং ইনসেনটিভ (উৎসাহ) দিতে হবে।
টেসলা ও অ্যাপেল কেন বিদেশে ম্যানুফ্যাকচারিং করছে?
টেসলা, অ্যাপেলের মতো কোম্পানিগুলোও বিদেশি বাজারে উৎপাদন করছে। এর কারণ হল কম খরচ, দ্রুত উৎপাদন এবং ট্যাক্স বেনিফিট (কর সুবিধা)। ভারত, চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশে তারা শুধু সস্তা শ্রমিক দিয়েই কাজ করাতে পারে না, বরং সেখানকার বড় বাজারও এই কোম্পানিগুলোর জন্য লাভজনক।