ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ: জীবন ও মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ: জীবন ও মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ছিলেন একজন মহান যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক এবং স্বরাজের প্রবর্তক। তিনি মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ভারতে স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার শিখা জ্বালিয়েছিলেন। তাঁর জীবন পরাক্রম, নীতি এবং ধর্মানুভূতির প্রতীক, যা আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।

Shivaji: ভারতের ইতিহাসে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। একজন মহান যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক এবং জননায়ক হিসেবে শিবাজী কেবল মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেননি, বরং বিদেশী ও দেশীয় শাসকদের সামনে ভারতীয় আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রবন্ধে আমরা শিবাজী মহারাজের জীবন, সংগ্রাম, কৃতিত্ব এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মারাঠা শাসনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

প্রাথমিক জীবন ও পটভূমি

শিবাজীর জন্ম শিবনেরী দুর্গে ১৯ ফেব্রুয়ারি হয়েছিল (যদিও পণ্ডিতদের মধ্যে জন্ম তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে)। তিনি শাহাজী ভোঁসলে এবং জিজাবাইয়ের পুত্র ছিলেন। শাহাজী ছিলেন একজন মারাঠা সেনাপতি যিনি বিজাপুর এবং আহমেদনগরের মতো দক্ষিণ সালতানাতের জন্য কাজ করতেন। জিজাবাই ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ও প্রভাবশালী মহিলা, যিনি শিবাজীর মধ্যে ধর্ম, সাহস ও ন্যায়ের অনুভূতি গভীরভাবে প্রোথিত করেছিলেন। শিবাজীর শৈশবকাল পুনেতে কাটে, যেখানে দাদোজি কোন্ডদেব তাঁকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করেন। প্রথম থেকেই শিবাজীর মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, যুদ্ধ কৌশল এবং কৌশলগত চিন্তাভাবনার লক্ষণ স্পষ্ট দেখা যায়।

বিজাপুর সালতানাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

কৈশোরেই শিবাজী বিজাপুর সালতানাতের অধীনে থাকা দুর্গগুলির প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে একের পর এক স্বাধীন দুর্গ দখল করতে শুরু করেন। ১৬৪৬ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে, তিনি তোরনা দুর্গ জয় করেন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত ধন দিয়ে রাজগড় দুর্গ নির্মাণ করান। এর পরে তিনি পুরন্দর, কোন্ডানা, চাকনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুর্গগুলির দখল নেন। শিবাজীর ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে বিজাপুর তাঁর পিতা শাহাজীকে বন্দী করে। ১৬৪৯ সালে শাহাজীর মুক্তির পরে শিবাজী কিছু সময়ের জন্য যুদ্ধ বন্ধ রাখেন, কিন্তু খুব শীঘ্রই তিনি জাভলি উপত্যকা দখল করেন, যা তাঁর কৌশলগত বিস্তারের দিকে একটি নির্ণায়ক পদক্ষেপ ছিল।

আফজল খানের সঙ্গে মোকাবিলা ও প্রতাপগড়ের বিজয়

১৬৫৭ সালে বিজাপুরের শক্তিশালী সেনাপতি আফজল খানকে শিবাজীকে বন্দী করার জন্য পাঠানো হয়। প্রতাপগড়ের কাছে একটি কুঁড়েঘরে দুজনের দেখা হয়, যেখানে শিবাজী কৌশলে আফজল খানকে হত্যা করেন। এর পরে মারাঠা সেনাবাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে বিজাপুরের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। এটি ছিল শিবাজীর প্রথম বড় সামরিক বিজয় যা তাঁকে একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

মুঘলদের সঙ্গে সংঘাত ও শায়েস্তা খানের ওপর হামলা

প্রথমে শিবাজী মুঘলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যখন তিনি সম্মান পেলেন না, তখন তিনি মুঘলদের অঞ্চলে আক্রমণ শুরু করেন। ১৬৬৩ সালে তিনি পুনেতে বসবাসকারী মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের ওপর রাতে হামলা চালিয়ে তাকে আহত করেন। এই ঘটনা মুঘলদের মর্যাদাকে গভীর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর জবাবে ঔরঙ্গজেব জয়সিংহকে শিবাজীর বিরুদ্ধে পাঠান। জয়সিংহের সেনাবাহিনী শিবাজীর অনেকগুলো দুর্গ দখল করে নেয়, যার ফলস্বরূপ ১৬৬৫ সালে পুরন্দরের চুক্তি হয়। শিবাজীকে ২৩টি দুর্গ মুঘলদের হাতে তুলে দিতে হয় এবং তাঁকে একজন জায়গীরদার হিসেবে মেনে নেওয়া হয়।

আগ্রা থেকে পালানোর ঐতিহাসিক ঘটনা

১৬৬৬ সালে শিবাজী ও তাঁর পুত্র संभाजी কে ঔরঙ্গজেব আগ্রায় ডেকে পাঠান। সেখানে তাঁদের অপমান করে বন্দী করা হয়। শিবাজী বুদ্ধি ও সাহসের পরিচয় দিয়ে মিষ্টির ঝুড়িতে লুকিয়ে আগ্রা থেকে সফলভাবে পালিয়ে যান। এটি ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি।

পুনরায় শক্তিশালী হওয়া ও সাম্রাজ্য বিস্তার

আগ্রা থেকে ফিরে আসার পরে শিবাজী আবার তাঁর সামরিক অভিযান শুরু করেন। ১৬৭০ সালে তিনি মুঘলদের কাছ থেকে হারানো দুর্গগুলি পুনরুদ্ধার করেন এবং আবারও সুরাট আক্রমণ করে তা লুট করেন। ইংরেজরা তাঁকে অস্ত্র দিতে অস্বীকার করলে তাদের সঙ্গেও তাঁর সংঘাত হয়। শিবাজী শুধু স্থলভাগে শক্তি বাড়াননি, বরং সমুদ্র শক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে একটি সুসংগঠিত নৌবাহিনীও তৈরি করেন। তিনি কোঙ্কন উপকূলে অনেক দুর্গ নির্মাণ করেন, যা মারাঠা সাম্রাজ্যের সমুদ্র সুরক্ষা জোরদার করে।

রাজ্যাভিষেক ও হিন্দভি স্বরাজ্যের প্রতিষ্ঠা

১৬৭৪ সালে রায়গড় দুর্গে শিবাজীর যথাযথ রাজ্যাভিষেক হয় এবং তাঁকে 'ছত্রপতি' উপাধি দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণরা বৈদিক রীতি মেনে অভিষেক করেন। তিনি নিজেকে হিন্দু রাজা ঘোষণা করেন এবং হিন্দভি স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন – এমন একটি রাজ্য যা ধর্ম, সংস্কৃতি ও ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। শিবাজীর রাজ্যাভিষেক তাঁকে আইনি ও ধর্মীয় বৈধতা দেয়। এখন তিনি কেবল একজন বিদ্রোহী সর্দার ছিলেন না, বরং একজন বৈধ সম্রাট ছিলেন। এই রাজ্যাভিষেক মারাঠাদের মধ্যে নতুন চেতনা ও গর্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

প্রশাসনিক সংস্কার ও নীতি

শিবাজী শুধু একজন মহান যোদ্ধাই ছিলেন না, একজন দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন। তিনি একটি সুসংগঠিত এবং দায়বদ্ধ প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন। তাঁর প্রশাসনে আটজন মন্ত্রী ছিলেন, যাঁদের 'অষ্টप्रधान' বলা হত। এঁদের মধ্যে ছিলেন পেশোয়া, আমাত্য, सुमंत, মন্ত্রী, সেনাপতি, সচিব, পণ্ডিতরাও এবং न्यायाधीश। তিনি কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন, কর ব্যবস্থাকে সরল ও ন্যায্য করেন এবং কর্মকর্তাদের ওপর নজর রাখার জন্য একটি গোয়েন্দা ব্যবস্থা তৈরি করেন। তাঁর প্রশাসন ধর্মনিরপেক্ষ ছিল এবং তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি ন্যায়বিচার করতেন।

উত্তরাধিকার ও শেষ সময়

১৬৮০ সালের ৩ এপ্রিল রায়গড়ে শিবাজীর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র संभाजी महाराज সাম্রাজ্যের হাল ধরেন। যদিও শিবাজীর জীবন অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত ছিল, কিন্তু তিনি তাঁর কাজ ও চিন্তা দিয়ে যে ছাপ রেখে গেছেন, তা ভারতীয় ইতিহাসে অমলিন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তাঁর অদম্য সাহস, দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে একটি শক্তিশালী মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি হিন্দভি স্বরাজ্যের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে ভারতীয় জনগণের মধ্যে আত্মগৌরব ও স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়েছিলেন। তাঁর জীবন আজও অনুপ্রেরণার উৎস।

Leave a comment