বিবাহবিচ্ছেদ মানেই শুধুই মানসিক আঘাত নয়
বিবাহবিচ্ছেদ জীবনে শুধু মানসিক চাপই নয়, আর্থিক ধাক্কাও আনে। অনেক সময় বিচ্ছেদের পর এক পক্ষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে না। সেই পরিস্থিতিতে আদালত থেকে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা ভরণপোষণ বা অ্যালিমনি (Alimony) নামে পরিচিত।
ভারতে ভরণপোষণের আইন ও উদ্দেশ্য
ভারতে ভরণপোষণের বিধান বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইন ও ১৯৭৩ সালের Code of Criminal Procedure (CrPC)-এর আওতায় সংজ্ঞায়িত। মূল উদ্দেশ্য হল—বিচ্ছেদের পরও আর্থিকভাবে দুর্বল পক্ষকে ন্যূনতম মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করার নিশ্চয়তা দেওয়া। তবে এটি একরকম নয়; মামলার ধরন, পরিস্থিতি এবং প্রাপকের আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে ভরণপোষণের ধরণ পরিবর্তিত হতে পারে।ভরণপোষণের ধরনবিচ্ছেদের পর বিভিন্ন ধরনের খোরপোশ প্রদান করা হয়।
ভারতের আইন অনুযায়ী এগুলি প্রধানত ছয় প্রকারে বিভক্ত—
স্থায়ী ভরণপোষণ (Permanent Alimony)
যেসব স্বামী বা স্ত্রী দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন অনুভব করেন, তাদের জন্য স্থায়ী ভরণপোষণ দেওয়া হয়। এটি সাধারণত অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রযোজ্য, তবে প্রাপক পুনর্বিবাহ করলে বা মৃত্যুবরণ করলে বন্ধ হয়ে যায়। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৯৫৫-এর ধারা ২৫ অনুযায়ী এটি কার্যকর।বিচ্ছেদের মামলা চলাকালীন অস্থায়ী ভরণপোষণ প্রদান করা হয়। এর মধ্যে আইনজীবীর খরচ, দৈনন্দিন জীবন ও মামলার চলাকালীন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। হিন্দু আইন ধারা ২৪ এবং CrPC ধারা ১২৫ অনুযায়ী এটি নিয়ন্ত্রিত।
পুনর্বাসনমূলক ভরণপোষণ (Rehabilitative Alimony)
সীমিত সময়ের জন্য দেওয়া হয় যাতে আর্থিকভাবে দুর্বল পক্ষ স্বনির্ভর হতে পারে। শিক্ষালাভ বা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাই মূল উদ্দেশ্য। কতদিন ভরণপোষণ দেওয়া হবে, তা আদালত পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ করে।
প্রতিপূরণমূলক ভরণপোষণ (Reimbursement / Compensatory Alimony)
যদি সংসারের কারণে একজন স্বামী/স্ত্রী তার চাকরি বা অর্থনৈতিক ক্যারিয়ার বিসর্জন দেন, তবে আদালত প্রতিপূরণ হিসেবে এই ভরণপোষণ নির্ধারণ করে। ন্যায্যতার নীতি (Equitable Principles) এখানে প্রযোজ্য।
এককালীন ভরণপোষণ (Lump Sum Alimony)
মাসিক ভরণপোষণের পরিবর্তে একবারে অর্থ প্রদান করা হয়। এতে মাসে মাসে আর্থিক ঝামেলা এড়ানো যায়। প্রাপক এই অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ, বাড়ি কেনা বা অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন।
নামমাত্র ভরণপোষণ (Nominal Alimony)
খুব অল্প পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়। মূল উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতে প্রয়োজনে অধিক ভরণপোষণ দাবির আইনি অধিকার সংরক্ষিত রাখা।
বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইন অনুযায়ী ভরণপোষণ
হিন্দু আইন: ধারা ২৪ ও ২৫ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন এবং স্থায়ী ভরণপোষণের ব্যবস্থা।
মুসলিম আইন: ইদ্দতকালীন (৩ মাস) সময়কালে সাধারণত খোরপোশ প্রদান।
খ্রিস্টান আইন: ১৮৬৯ সালের ভারতীয় বিবাহবিচ্ছেদ আইন ধারা ৩৬ ও ৩৭ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ।
পারসি আইন: ১৯৩৬ সালের পার্সি বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪: আন্তঃধর্মীয় বিবাহে প্রযোজ্য, ধারা ৩৬ ও ৩৭ অনুসারে।
আর্থিক সক্ষমতা ও ভবিষ্যতের উপার্জনবিচ্ছেদের সময় বেকার থাকলেও, যথেষ্ট যোগ্যতা ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থাকলে কম খোরপোশ নির্ধারিত হতে পারে। আইন স্বনির্ভরতার সুযোগ প্রদান করে। (কল্যাণ দে চৌধুরী বনাম রীতা দে চৌধুরী, ২০১৭, ১৪ SCC ২০০)
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান ও খোরপোশ
ঝাড়খণ্ড হাইকোর্টের একটি মামলায়, সন্তান অটিজম স্পেকট্রামে থাকার কারণে মাতার জন্য মাসিক খোরপোশ ৯০,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পূর্ণকালীন যত্নশীল থাকায় মা নিয়মিত চাকরি করতে অক্ষম।
সম্পত্তি, ঋণ ও অর্থনৈতিক বোঝা
ভরণপোষণ, শিশু ভরণপোষণ এবং যৌথ সম্পত্তি/ঋণ মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ। গৃহঋণ, গাড়ি ঋণ, ব্যাংক ঋণ থেকে নাম সরিয়ে রাখা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে আর্থিক বোঝা এড়ানো যায়।
আর্থিক পরিকল্পনা ও স্বনির্ভরতা
আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হলে বিচ্ছেদের পরে বাজেট তৈরি করুন, পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলুন, বীমা ও বিনিয়োগের মনোনয়ন আপডেট করুন। খোরপোশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক চাপ বিবেচনা করুন এবং সম্পত্তি সমানভাবে ভাগ করুন।
করযোগ্যতা ও আইনগত দিক
এককালীন খোরপোশ করমুক্ত, তবে মাসিক প্রদান হলে প্রাপকের আয়ের অংশ। অস্থাবর সম্পত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে মূলধন লাভ কর প্রযোজ্য। শিশু ভরণপোষণ ও উত্তরাধিকার বিষয়ে আইন অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রয়োজন।
আইনজীবী ও আর্থিক পরামর্শ
বিবাহবিচ্ছেদের পরে নিজের আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবী এবং আর্থিক পরিকল্পনাকারীর সাহায্য নিন।