জাস্টিস সূর্যকান্ত ভারতের ৫৩তম প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন: জানুন তাঁর কর্মজীবনের ৪টি ঐতিহাসিক রায়

জাস্টিস সূর্যকান্ত ভারতের ৫৩তম প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন: জানুন তাঁর কর্মজীবনের ৪টি ঐতিহাসিক রায়

ভারত শীঘ্রই তার ৫৩তম প্রধান বিচারপতি (Chief Justice of India)-কে স্বাগত জানাতে চলেছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণতম বিচারপতি জাস্টিস সূর্যকান্তকে (Justice Surya Kant) দেশের পরবর্তী CJI হিসাবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। 

নয়াদিল্লি: ভারতের প্রধান বিচারপতি বি. আর. গাভাই কেন্দ্র সরকারের কাছে জাস্টিস সূর্যকান্তকে দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি (CJI) হিসাবে নিয়োগের সুপারিশ পাঠিয়েছেন। বর্তমানে জাস্টিস সূর্যকান্ত সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় প্রবীণতম বিচারপতি। যদি কেন্দ্র সরকার এই সুপারিশ অনুমোদন করে, তাহলে তিনি ২০২৫ সালের ২৪শে নভেম্বর দেশের ৫৩তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করবেন।

বর্তমান CJI বি. আর. গাভাই ২৩শে নভেম্বর অবসর গ্রহণ করবেন। এরপর ঐতিহ্য অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণতম বিচারপতিকেই পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ করা হয়।

জাস্টিস সূর্যকান্তের সাধারণ পরিবার থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পথচলা

জাস্টিস সূর্যকান্তের জন্ম ১৯৬২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি হরিয়ানার হিসার জেলার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়েছিল। তার জীবন বিলাসিতা থেকে বহু দূরে, গ্রামীণ পরিবেশে কেটেছে। তিনি তার গ্রাম পেতওয়ার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং ১৯৮৪ সালে মহার্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় (MDU) থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি হিসার জেলা আদালত থেকে ওকালতি শুরু করেন, এরপর তিনি চণ্ডীগড় চলে যান এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে অনুশীলন শুরু করেন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি হরিয়ানার সর্বকনিষ্ঠ অ্যাডভোকেট জেনারেল (Advocate General) হন। তার আইনি জ্ঞান এবং কঠোর বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে দ্রুত উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ২০১৯ সালের ২৪শে মে তাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

CJI হিসাবে জাস্টিস সূর্যকান্তের কার্যকাল প্রায় ১৫ মাস হবে। তিনি ২০২৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করবেন। সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম অনুযায়ী, বিচারপতির অবসরের বয়স ৬৫ বছর নির্ধারিত।

জাস্টিস সূর্যকান্তের ৪টি বড় এবং ঐতিহাসিক মামলা

জাস্টিস সূর্যকান্তের বিচারিক কর্মজীবন সাহসী ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তে পরিপূর্ণ ছিল। তাঁর অনেক রায় কেবল আইনি ব্যবস্থাকেই পথ দেখায়নি, বরং সমাজে গভীর আলোচনাও তৈরি করেছে। আসুন জেনে নিই তাঁর চারটি সবচেয়ে আলোচিত মামলা সম্পর্কে —

১. রণবীর আল্লাহবাদিয়া মামলা: “জনপ্রিয়তা দিয়ে নয়, মর্যাদা দিয়ে মানুষ বড় হয়”

বিখ্যাত ইউটিউবার রণবীর আল্লাহবাদিয়ার আবেদনের শুনানির সময় জাস্টিস সূর্যকান্ত তীব্র মন্তব্য করে বলেছিলেন যে, এই ব্যক্তির মনে কিছু নোংরা জিনিস আছে যা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। সে তার বাবা-মায়েরও অপমান করছে। আদালত কেন তার পক্ষ নেবে? তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা কাউকে সামাজিক মর্যাদা ভাঙার অধিকার দেয় না। এই মন্তব্যটি তরুণ এবং ইনফ্লুয়েন্সারদের মধ্যে একটি বড় বার্তা হয়ে ওঠে।

২. নূপুর শর্মা মামলা: “জনসাধারণের পদে থাকা ব্যক্তিদের কথার গুরুত্ব বোঝা উচিত”

বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের পর দেশজুড়ে প্রতিবাদের মধ্যে, জাস্টিস সূর্যকান্ত শুনানির সময় বলেছিলেন, দেশে যা কিছু ঘটছে তার জন্য তিনিই একমাত্র দায়ী। তিনি বলেন, ক্ষমতা বা জনসাধারণের পদে থাকা ব্যক্তির তার কথার প্রভাব সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। এই মন্তব্যটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং দায়িত্বের মধ্যেকার রেখাকে স্পষ্ট করে।

৩. স্বাতী মালিওয়াল মামলা: “এটা কি মুখ্যমন্ত্রীর বাসস্থান নাকি কোনো গুন্ডার আস্তানা?”

আপ সাংসদ স্বাতী মালিওয়ালের ওপর হামলার ঘটনায় জাস্টিস সূর্যকান্তের তিরস্কার গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তিনি অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, একটি মহিলার সাথে এমন কাজ করতে তার লজ্জা হয়নি? তিনি বলেন, যখন একজন মহিলা কাঁদছিলেন এবং সাহায্য চাইছিলেন, তখনও তাকে থামানো হয়নি — এটি নিন্দনীয়। তাঁর এই মন্তব্য নারী নিরাপত্তা এবং সাংবিধানিক মর্যাদার ওপর একটি কঠোর বার্তা হিসাবে দেখা হয়েছে।

৪. মোহাম্মদ জুবায়ের মামলা: “মত প্রকাশ করা অপরাধ নয়”

২০২২ সালে ফ্যাক্ট-চেকার মোহাম্মদ জুবায়েরের গ্রেপ্তারের মামলায় জাস্টিস সূর্যকান্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, কোনো নাগরিককে তার মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা অসাংবিধানিক। সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত প্রকাশ করা অপরাধ হতে পারে না। এই রায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে একটি মাইলফলক প্রমাণিত হয়েছে।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রায় এবং উদ্যোগ

  • রাজদ্রোহ আইনে স্থগিতাদেশ: জাস্টিস সূর্যকান্ত সেই বেঞ্চের অংশ ছিলেন, যা ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ (সেডিশন) আইনের বৈধতার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে এবং সরকারকে পুনর্বিবেচনা না হওয়া পর্যন্ত নতুন FIR নথিভুক্ত না করার নির্দেশ দেয়।
  • নির্বাচনে স্বচ্ছতা: তিনি বিহারের ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়া ৬৫ লক্ষ নামের বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
  • নারীদের জন্য সংরক্ষণ: সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনে এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার নির্দেশ দেওয়ার কৃতিত্বও তাকে দেওয়া হয়।
  • ওয়ান র‍্যাঙ্ক-ওয়ান পেনশন (OROP): তিনি এই প্রকল্পটিকে সাংবিধানিকভাবে বৈধ বলে ঘোষণা করেন এবং এটি বজায় রাখার নির্দেশ দেন।
  • পেগাসাস গুপ্তচরবৃত্তি মামলা: তিনি সেই বেঞ্চের অংশ ছিলেন যা অবৈধ নজরদারির অভিযোগ তদন্তের জন্য সাইবার বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল গঠন করেছিল।
  • প্রধানমন্ত্রীর পাঞ্জাব সফর মামলা: তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীর নিরাপত্তায় ত্রুটির ঘটনায় বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রার সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন, এই বলে যে “এই ধরনের ক্ষেত্রে বিচারিকভাবে প্রশিক্ষিত মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়।

জাস্টিস সূর্যকান্ত তার ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুভূতি এবং সংবিধানের প্রতি অটল নিষ্ঠার জন্য পরিচিত। তিনি কেবল আইনের সূক্ষ্মতা বোঝেন না, বরং এটিকে সাধারণ নাগরিকদের সংবেদনশীলতার সাথে যুক্ত করার দক্ষতাও রাখেন।

Leave a comment