মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র কেবল একটি নাম নয়, বরং মানব ইতিহাসের সেই প্রতীক যিনি প্রমাণ করেছেন যে, সহিংসতা ছাড়াই সমাজের গভীরে প্রোথিত অন্যায়পূর্ণ ব্যবস্থাকেও পরিবর্তন করা সম্ভব। ১৯২৯ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান নাগরিক অধিকার নেতা তাঁর জীবনের মাত্র ৩৯ বছরে এমন এক ছাপ রেখে গেছেন, যা আজও বিশ্বকে পথ দেখায়।
বর্ণবৈষম্যের শৃঙ্খলে বাঁধা আমেরিকা
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত। স্কুল, বাস, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল— সর্বত্র 'হোয়াইট' এবং 'কালার্ড'-দের জন্য আলাদা বোর্ড লাগানো থাকত। কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার সীমিত ছিল এবং তাঁদের হিংসা ও সামাজিক অবজ্ঞার শিকার হতে হত। এমন সময়ে কিং এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই অন্যায়পূর্ণ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই হবে।
প্রারম্ভিক জীবন এবং পারিবারিক সংস্কার
আটলান্টা (জর্জিয়া)-তে জন্ম নেওয়া কিং-এর শৈশব ধর্মীয় পরিবেশে কাটে। তাঁর বাবা স্বয়ং একজন ব্যাপ্টিস্ট পাদ্রী ছিলেন, যিনি তাঁকে সত্য, সততা এবং সাম্যের সংস্কার দিয়েছিলেন। শৈশবে যখন তাঁর শ্বেতাঙ্গ বন্ধুর বাবা-মা তাঁকে খেলতে বাধা দেন, তখন কিং প্রথমবার অনুভব করেন যে, বর্ণবৈষম্য কেবল একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি সামাজিক কাঠামো। তাঁর বাবার সাহসী উদাহরণ—যেমন কোনো পুলিশকর্মীকে ‘আমি ছেলে নই, মানুষ’ বলা—তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল।
শিক্ষা এবং ধারণার বিস্তার
কিং-এর শিক্ষা তাঁর ব্যক্তিত্বকে নতুন আকার দেয়। মোরহাউস কলেজ এবং পরে বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে তিনি ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এবং নৈতিক দর্শন অধ্যয়ন করেন। এখানেই তিনি মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা ও সত্যাগ্রহের ধারণা পড়েন। গান্ধীর চিন্তা কিংকে এই বিশ্বাস জন্মায় যে, হিংসার প্রতিরোধ কেবল অহিংসা দিয়েই সম্ভব। এই দর্শনই পরবর্তীতে তাঁর আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে।
নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব
১৯৫৫ সালের মন্টগোমারি বাস বয়কট কিং-এর নেতৃত্বের সূচনার প্রতীক হয়ে ওঠে। রোজা পার্কস নামক এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে শুধুমাত্র এই কারণে গ্রেফতার করা হয়েছিল কারণ তিনি বাসে একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে নিজের সিট ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। এই ঘটনা কৃষ্ণাঙ্গ সমাজকে আন্দোলিত করে তোলে। কিং শান্তিপূর্ণ বয়কটের আহ্বান জানান। ৩৮১ দিন ধরে চলা এই আন্দোলন শুধুমাত্র বাসের বৈষম্যমূলক আইনকেই শেষ করেনি, বরং কিংকে জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
'আই হ্যাভ এ ড্রিম': শব্দে খাড়া হওয়া বিপ্লব
১৯৬৩ সালের মার্চ অন ওয়াশিংটন আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। এখানে কিং তাঁর বিখ্যাত ভাষণ 'I Have a Dream' দেন। তাঁর শব্দ— 'আমার একটি স্বপ্ন আছে যে একদিন এই জাতি জেগে উঠবে এবং তার আদর্শের সত্য অর্থ উপলব্ধি করবে—যে সকল মানুষ সমানভাবে তৈরি হয়েছে।' এই ভাষণ কেবল একটি রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না; এটি ছিল একটি নৈতিক আহ্বান যা লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল।
সংগ্রাম, সমালোচনা এবং সাহস
কিং-এর জীবন শুধুমাত্র প্রশংসায় পরিপূর্ণ ছিল না। এফবিআই তাঁকে 'কট্টরপন্থী' মনে করে তাঁর উপর নজরদারি চালায়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা হয়, হুমকি চিঠি পাঠানো হয়, এমনকি আত্মহত্যা করার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করা হয়। বহুবার তিনি জেল খেটেছেন, হিংসা সহ্য করেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর নীতি থেকে সরে আসেননি। তিনি জানতেন যে, প্রকৃত পরিবর্তনের পথ কঠিন হয়, কিন্তু স্থায়ী হয়।
শেষ বছর এবং অমর উত্তরাধিকার
১৯৬৮ সালে যখন কিং দারিদ্র্য এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে Poor People’s Campaign-এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন মেম্ফিস (টেনেসি)-এ তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর আমেরিকায় দাঙ্গা হয়, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়—সিভিল রাইটস অ্যাক্ট (১৯৬৪), ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট (১৯৬৫) এবং ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্ট (১৯৬৮)-এর মতো আইন তৈরি হয়। আজ তাঁর জন্মদিন জাতীয় ছুটি (Martin Luther King Jr. Day) হিসেবে পালিত হয় এবং ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে তাঁর স্মৃতিতে তৈরি স্মারক এটি জানায় যে, অহিংসার পথ কখনো বৃথা যায় না।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জীবন এই প্রমাণ যে, সাহস, ধৈর্য এবং অহিংসা দিয়ে সমাজে গভীরে প্রোথিত অন্যায়পূর্ণ ব্যবস্থাকেও পরিবর্তন করা যেতে পারে। তাঁর চিন্তা আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক, কারণ পৃথিবীতে এখনও বৈষম্য এবং অসমতার রূপ বিদ্যমান। আমাদের তাঁর শিক্ষা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এমন একটি সমাজের দিকে পদক্ষেপ বাড়ানো উচিত, যেখানে সাম্য, প্রেম এবং ন্যায় সর্বাগ্রে থাকে।