প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দেশজুড়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয় রাখিবন্ধন উৎসব। এই উৎসব কেবল একটি প্রথা নয়, বরং ভাই-বোনের সম্পর্কের দৃঢ়তা ও বিশ্বাসের প্রতীক। এই দিনে বোনেরা তাদের ভাইদের হাতে রাখিসূত্র বাঁধে এবং তাদের দীর্ঘায়ু, সাফল্য ও সুখ-শান্তি কামনা করে। অন্যদিকে, ভাইয়েরা বোনদের সারা জীবন রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং উপহারস্বরূপ তাদের কিছু দেয়।
কবে রাখিবন্ধন এবং শুভ মুহূর্ত কী?
এ বছর রাখিবন্ধন উৎসব ৯ই আগস্ট ২০২৫, শনিবার পালিত হবে। পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, এই দিন পূর্ণিমা তিথি সারাদিন থাকবে। রাখি বাঁধার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় অভিজিৎ মুহূর্ত, যা দুপুর ১২টা থেকে ১২টা ৫৩ মিনিট পর্যন্ত থাকবে। এছাড়াও, ব্রহ্ম মুহূর্ত ভোর ৪টে ২২ মিনিট থেকে ৫টা ৪ মিনিট পর্যন্ত থাকবে, যা পূজা ও জপ-ধ্যানের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
রাখি বাঁধার সময় অবশ্যই এই বিশেষ মন্ত্র পাঠ করুন
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে রাখিসূত্র কেবল একটি সুতো নয়, বরং এটি একটি ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক সুরক্ষা কবচ। যদি রাখি বাঁধার সময় মন্ত্র জপ করা হয়, তবে এই সূত্র ভাইয়ের রক্ষার পাশাপাশি তাকে শক্তি, উদ্যম এবং ইতিবাচকতা প্রদান করে।
রাখিসূত্র বাঁধার সময় বোনদের এই মন্ত্র পাঠ করা উচিত
"যেন বद्धো বলি রাজা, দানবেন্দ্রো মহাবলঃ।
তেন ত্বাম্ प्रतिबद्धনামী, রক্ষে মাচল মাচলঃ।"
এই মন্ত্রের অর্থ হল - "যে রক্ষাসূত্র দ্বারা শক্তিশালী দানবদের রাজা বলিকে বাঁধা হয়েছিল, সেই সূত্র দিয়েই আমি তোমাকে বাঁধছি। হে রক্ষা, তুমি অটল থেকো, অটল থেকো।"
মন্ত্র জপ থেকে মনোবল ও আধ্যাত্মিক শক্তি পাওয়া যায়
পণ্ডিত ও শাস্ত্র অনুসারে, মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় রাখি বাঁধলে রাখিসূত্র একটি সংকল্পে পরিণত হয়। এই সংকল্প কেবল বোন ও ভাইয়ের মধ্যে নয়, বরং ঈশ্বর ও প্রকৃতির মধ্যে একটি প্রতিশ্রুতি যে এই রক্ষাসূত্র ভাইকে সব সংকট, রোগ, কুনজর ও দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা করবে। এমন পরিস্থিতিতে মন্ত্র ছাড়া রাখি বাঁধা কেবল একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যেখানে মন্ত্রের সাথে এটি একটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে।
বাড়ির বয়স্করাও রাখিসূত্রের ব্যবহার করতে পারেন
রাখিবন্ধন উৎসব শুধুমাত্র ভাই-বোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রথা অনুসারে, রাখিসূত্র বাড়ির বয়স্ক, গুরুজন বা পুরোহিতরাও তাদের শিষ্য, সন্তান বা সমাজের সুরক্ষার জন্য বাঁধতে পারেন। এই সূত্রটি যে কোনও প্রিয়জনের নিরাপত্তা, সাফল্য ও সুখের জন্য বাঁধা যেতে পারে।
রাখি বাঁধার পুরনো প্রথা এবং পরিবর্তিত সময়
রাখিবন্ধনের প্রথা বহু পুরনো। ধারণা করা হয়, দেব-দানব যুদ্ধের সময় ইন্দ্রাণী তার স্বামী ইন্দ্রকে রক্ষাসূত্র বেঁধেছিলেন, যা তাকে যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করেছিল। এই প্রথা অনুসরণ করে আজও বোনেরা তাদের ভাইদের হাতে রাখি বাঁধে।
তবে সময়ের সাথে সাথে রাখিবন্ধনের রূপও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। এখন শুধু বোনেরাই নয়, অনেক সময় ভাইয়েরাও বোনদের রাখি বাঁধে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা তাদের সব পরিস্থিতিতে রক্ষা করবে। কিছু বাড়িতে বোনেরা একে অপরের হাতেও রাখি বাঁধে, যা প্রেম ও ঐক্যের বার্তা দেয়।
ভাইয়ের সাফল্যের জন্য বোনেরা বিশেষ পূজা করে
রাখি বাঁধার পাশাপাশি বোনেরা এই দিনে বিশেষ পূজা করে। তারা ভগবান বিষ্ণু, গণেশ ও হনুমানজির পূজা করে তাদের ভাইদের ভালো স্বাস্থ্য, দীর্ঘ জীবন এবং জীবনে উন্নতির জন্য প্রার্থনা করে। অনেক স্থানে মহিলারা তাদের ভাইয়ের নামে ব্রত পালন করে এবং মন্ত্র জপ সহ পূজা করে।
রাখিবন্ধনের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব
রাখিবন্ধন শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সামাজিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই উৎসব ভাই-বোনের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সমাজে প্রেম, সহযোগিতা ও ঐক্যের भावना বাড়ায়। এটি এমন একটি দিন যখন পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়, সম্পর্কের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক বিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে।
৯ই আগস্টে সাজবে রাখির উৎসব, বাঁধন হবে ভালোবাসার
এবার ৯ই আগস্ট রাখিবন্ধন উৎসব শুধু ভাই-বোনকে কাছে আনবে না, বরং আবেগ, সংস্কার এবং ঐতিহ্যের সেই বাঁধনকে আরও দৃঢ় করবে যা যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে আসছে। মন্ত্র পাঠের সাথে বাঁধা রাখি, কেবল একটি সুতো নয়, বরং এটি একটি সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি, যা সারা জীবন চলে।