স্পেনের মুর্সিয়া শহরে মুসলিমদের ঈদ-এর মতো উৎসব পালন করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দক্ষিণপন্থী দলগুলোর সমর্থনে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায় এটিকে অসাংবিধানিক এবং বৈষম্যমূলক বলেছে।
স্পেন: দক্ষিণ ইউরোপের দেশ স্পেনের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মুর্সিয়ার একটি ছোট শহর জুমিলার স্থানীয় প্রশাসন মুসলমানদের ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলো সর্বজনীন স্থানে পালন করতে নিষেধ করেছে। শহরের পৌরসভা কর্তৃক গৃহীত একটি প্রস্তাবের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং এটি জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রস্তাবে কী বলা হয়েছে
প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, পৌরসভার খেলার সুবিধা এবং সর্বজনীন স্থান কোনো ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা যাবে না, যা শহরের 'পরিচিতি'-র সঙ্গে মেলে না। যদি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিজে এই ধরনের কার্যকলাপের আয়োজন না করে, তবে সেগুলোর অনুমতি দেওয়া হবে না।
কে প্রস্তাব রেখেছিল এবং কারা সমর্থন করেছিল
এই প্রস্তাব রক্ষণশীল দল 'পিপলস পার্টি' (PP) রেখেছিল। ভোটের সময় দক্ষিণপন্থী দল 'ভক্স' (VOX) অনুপস্থিত ছিল, তবে পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সিদ্ধান্তকে নিজেদের জয় বলে উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে, বামপন্থী দলগুলো এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু বিরোধিতা সত্ত্বেও এটি পাশ হয়ে যায়।
ভক্স পার্টির বক্তব্য
ভক্স পার্টি তাদের অফিসিয়াল X (পূর্বের টুইটার) হ্যান্ডেলে লিখেছে, "ভক্সের দৌলতে স্পেনের সর্বজনীন স্থানে ইসলামী উৎসব পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রথম পদক্ষেপ সফল হয়েছে। স্পেন চিরকাল খ্রিস্টানদের ভূমি ছিল এবং থাকবে।"
স্প্যানিশ ফেডারেশন অফ ইসলামিক অর্গানাইজেশনের সভাপতি মুনির বেনজেলোন আন্দালুসি আজহারি এই সিদ্ধান্তকে 'ইসলামোফোবিক' এবং বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন যে এই সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে ইসলামিক সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে নেওয়া হয়েছে, যেখানে অন্য ধর্মগুলোর উপর এই ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
স্থানীয় নেতাদের সমালোচনা
মুর্সিয়ার সমাজবাদী নেতা ফ্রান্সিসকো লুকাস অভিযোগ করেছেন যে এই সিদ্ধান্ত স্প্যানিশ সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। এই অনুচ্ছেদে ধর্ম, চিন্তা এবং উপাসনার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রাক্তন মেয়র জুয়ানা গার্ডিওলা প্রশ্ন তুলেছেন যে প্রশাসন মুসলিম ঐতিহ্যকে অস্বীকার করছে কিনা, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের অংশ হয়ে রয়েছে।
আইনি চ্যালেঞ্জের প্রস্তুতি
দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এই সিদ্ধান্তকে আইনিভাবে চ্যালেঞ্জ করা হবে। মনে করা হচ্ছে যে এই নিষেধাজ্ঞা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী। সংবিধান অনুযায়ী, ধর্মীয় স্বাধীনতাকে শুধুমাত্র তখনই সীমিত করা যেতে পারে যখন তা সরাসরি জনশৃঙ্খলাকে প্রভাবিত করে।
মুসলিম ঐতিহ্য এবং জুমিলার ইতিহাস
জুমিলার ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে এই অঞ্চল একসময় মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে আরবরা এটি দখল করে এবং এর নাম রাখে ইউমিল-লা। এই অঞ্চল দীর্ঘকাল ধরে মুসলিম সংস্কৃতি ও প্রশাসনের কেন্দ্র ছিল। তবে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের আলফোনসো দশম এটি দখল করে নেয় এবং পরে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
আজকের জুমিলার মুসলিম জনসংখ্যা
আজ জুমিলার জনসংখ্যা প্রায় ২৭,০০০, যার মধ্যে প্রায় ৭.৫% মানুষ মুসলিম দেশ থেকে আসা অভিবাসী। এদের উপস্থিতি শহরের সংস্কৃতি ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় উৎসবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এই সামাজিক সম্প্রীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
ইউরোপে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত
এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র স্পেন নয়, বরং পুরো ইউরোপে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ও মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। গত কয়েক বছরে অনেক ইউরোপীয় দেশে অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইসলামোফোবিয়ার ঘটনা বৃদ্ধি এই সম্প্রদায়গুলোকে অরক্ষিত করে তুলেছে।