সনাতন ঐতিহ্যে প্রতিটি বাড়িতে একটি পূজার স্থান থাকা একটি সাধারণ ব্যাপার। বাড়ি ছোট হোক বা বড়, লোকেরা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও পূজার জন্য একটি কোণ অবশ্যই রাখে। কিন্তু অনেকেই জানেন না কীভাবে এবং কোথায় পূজার ঘর তৈরি করতে হয় যাতে সেখানে ইতিবাচক শক্তি বজায় থাকে এবং পুরো বাড়িতে তার ভালো প্রভাব পড়ে। বাস্তুশাস্ত্রে পূজার ঘর নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে যা মনে রাখা জরুরি।
কোথায় তৈরি করবেন ঘরের মন্দির
বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, বাড়ির পূজার স্থান উত্তর-পূর্ব দিকে অর্থাৎ ঈশান কোণে হওয়া উচিত। এটি দেবতাদের দিক হিসেবে বিবেচিত হয়। বলা হয়ে থাকে যে এই দিকে বাড়ির মন্দির তৈরি করলে ঘরে সুখ-শান্তি ও ইতিবাচক শক্তি বজায় থাকে। এই দিকে সূর্যের প্রথম কিরণ আসে, যা ঐশ্বরিক শক্তির সঞ্চার করে।
যদি কোনো কারণে ঈশান কোণে মন্দির তৈরি করা সম্ভব না হয়, তবে উত্তর বা পূর্ব দিককে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। মন্দির কোনো অবস্থাতেই দক্ষিণ-পশ্চিম, বাথরুমের পাশে বা রান্নাঘরের স্ল্যাবের উপর হওয়া উচিত নয়।
পূজা করার সময় দিক কেমন হওয়া উচিত
যখন পূজা করবেন, তখন ব্যক্তির মুখ পূর্ব বা উত্তর দিকে হওয়া উচিত। অনেক লোক এই বিভ্রান্তিতে থাকে যে ভগবান কোন দিকে আছেন, কিন্তু পূজা করার সময় জরুরি হলো ব্যক্তি নিজে কোন দিকে দেখছেন। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, কোনো ব্যক্তির রাশিফল অনুসারে পূজার দিক আরও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে সাধারণভাবে পূর্ব বা উত্তর দিক সবচেয়ে ভালো বলে মনে করা হয়।
মূর্তি কেমন হওয়া উচিত এবং কতটা বড় হওয়া উচিত
বাড়ির মন্দিরে রাখা মূর্তিগুলোর উচ্চতা নিয়েও বাস্তুতে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মূর্তিটির উচ্চতা দুই ইঞ্চি থেকে দশ ইঞ্চির মধ্যে হওয়া উচিত। এর চেয়ে বড় মূর্তি বাড়ির মন্দিরে রাখা উচিত নয়। এছাড়াও, ভাঙা বা ত্রুটিপূর্ণ মূর্তি রাখা উচিত নয়।
মন্দিরে একই দেবতার দুটি মূর্তি রাখা উচিত নয়। এছাড়া ত্রিভুজ আকারের মূর্তিগুলোও মন্দিরে না রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে এনে রাখা মূর্তিগুলো বিধি মেনে স্থাপন না করে না রাখাই ভালো।
মন্দিরে কোন কোন পাত্র রাখবেন
পূজার সময় তামার বাসন ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো বলে মনে করা হয়। যদি তামা না থাকে, তবে স্টিলের বাসন ব্যবহার করা যেতে পারে। প্লাস্টিক বা অ্যালুমিনিয়ামের বাসন এড়িয়ে যাওয়া উচিত। মন্দিরে পিতল বা কাঁসার প্রদীপ এবং ঘণ্টা রাখলে আরও ভালো হয়।
বাড়ির মন্দিরে কী করা উচিত নয়
বাড়ির মন্দিরটি কখনও শোবার ঘর বা টয়লেটের দেয়ালের সাথে তৈরি করা উচিত নয়। মন্দিরের দরজা এবং টয়লেটের দরজা মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়। এছাড়াও, রান্নাঘরের পাশে মন্দির তৈরি করাও শুভ বলে মনে করা হয় না।
ভগবানের মূর্তিগুলো একে অপরের ঠিক সামনে রাখা উচিত নয়। যদি দেয়ালে ক্যালেন্ডার বা ভগবানের ছবি লাগাতে হয়, তবে সেগুলো মুখোমুখি হতে পারে, তবে মূর্তি নয়।
গণেশ জীর মূর্তি কীভাবে লাগাবেন
বাড়ির প্রধান দরজায় গণেশ জীর দুটি মূর্তি ব্যাক টু ব্যাক লাগানো শুভ বলে মনে করা হয়। গণেশ জীর মুখ বাড়ির দিকে হওয়া উচিত যাতে ইতিবাচকতা ঘরে প্রবেশ করে। গণেশ জীর পিঠ বাড়ির দিকে রাখবেন না, কারণ এটি পাতাল লোকের দিকে ইঙ্গিত করে।
পূর্বপুরুষদের ছবি কোথায় লাগাবেন
বাড়িতে আপনার পিতৃপুরুষদের ছবি লাগানোর স্থানও বাস্তুশাস্ত্রে বলা হয়েছে। এই ধরনের ছবিগুলো বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে লাগানো উচিত। যদি সেই দিকটি উপলব্ধ না হয়, তবে দক্ষিণ দিকে লাগানোও উপযুক্ত। খেয়াল রাখবেন যে পূর্বপুরুষদের ছবি কখনও পূজার ঘরে রাখবেন না।
আলমারি এবং অন্যান্য সজ্জার স্থান
যদি পূজার ঘরে কোনো আলমারি রাখতে হয়, তবে সেটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হওয়া উচিত। এতে পূজার সামগ্রী, প্রদীপ, ধূপকাঠি, ঘি, তেল ইত্যাদি রাখা যেতে পারে। আলমারি ভারী হওয়া উচিত নয় এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখা উচিত।
পূজা করার আগে শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া
মন্দিরে যাওয়ার আগে স্নান করতে না পারলে, অন্তত পা শুদ্ধ করা জরুরি বলে মনে করা হয়। পা ধোয়ার জন্য সরাসরি হাত দিয়ে জল ঢালুন এবং বাম হাত দিয়ে পা ধুয়ে নিন। প্রথমে পায়ের পেছনের অংশ, তারপর সামনের দিক ধুতে হবে। সবশেষে মাথার উপর সামান্য জল ছিটিয়ে শরীরকে শুদ্ধ করা শুভ।
ঘরের পূজার স্থান কেবল বিশ্বাসের নয়, শক্তির কেন্দ্র
পূজার ঘরকে কেবল ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির স্থান হিসেবে মনে করা হয় না, এটি ঘরে শক্তি ও ইতিবাচকতার কেন্দ্র। যখন এই স্থানটি বাস্তু ও ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে হয়, তখন পুরো পরিবারের উপর এর ভালো প্রভাব পড়ে। ঘরে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে। তাই মন্দির সম্পর্কিত ছোট ছোট বিষয়গুলো উপেক্ষা করবেন না এবং আপনার পূজার ঘরটি বাস্তু অনুসারে তৈরি করুন।