ভারতের সংসদে শূন্য কাল: তাৎপর্য ও প্রক্রিয়া

ভারতের সংসদে শূন্য কাল: তাৎপর্য ও প্রক্রিয়া

ভারতীয় সংসদে 'শূন্য কাল' অর্থাৎ জিরো আওয়ার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময়টিতে সাংসদরা জনস্বার্থ সম্পর্কিত যেকোনো জরুরি এবং তাৎক্ষণিক বিষয় কোনো পূর্বসূচনা ছাড়াই উত্থাপন করার সুযোগ পান।

Zero Hour: ভারতীয় সংসদীয় কার্যক্রমে ‘শূন্য কাল’ বা জিরো আওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সেই সময় যখন সাংসদরা দেশ ও জনগণের সঙ্গে জড়িত অত্যন্ত জরুরি, সংবেদনশীল এবং তাৎক্ষণিক বিষয়গুলি সংসদের পटल‌ে উত্থাপন করেন। যদিও এই ব্যবস্থা ভারতীয় সংবিধান বা সংসদীয় কার্যবিধি (Rules of Procedure)-তে উল্লেখ নেই, তবুও ১৯৬২ সাল থেকে এই প্রথা চলে আসছে।

এটি লোকসভা ও রাজ্যসভা উভয় স্থানেই সমানভাবে প্রযোজ্য। ভারতে সংসদের বাদল অধিবেশন হোক বা শীতকালীন অধিবেশন, 'শূন্য কাল' সর্বদা আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে, কারণ এখান থেকেই অনেক সময় সরকারকে ঘেরাও করার শুরু হয়।

শূন্য কাল (Zero Hour) কেন বলা হয়?

'শূন্য কাল'-এর নামকরণ করা হয়েছে কারণ এটি প্রশ্নকাল (Question Hour)-এর ঠিক পরেই এবং সংসদের অন্যান্য সরকারি কাজকর্মের আগে আসে। লোকসভায় এটি দুপুর ১২টায় শুরু হয়, তাই একে 'শূন্য কাল' বলা হয়। রাজ্যসভায় ২০১৪ সালের পর পরিবর্তন হয়েছে এবং এখন রাজ্যসভায় শূন্য কাল সকাল ১১টায় শুরু হয়।

ডিকশনারিতে 'Zero Hour'-এর অর্থ হল – ‘চূড়ান্ত সময়’ বা 'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত'। সংসদে এর এটাই গুরুত্ব যে সাংসদরা সেই সময় সরকারের দৃষ্টি তাৎক্ষণিক বিষয়গুলির উপর আকর্ষণ করেন।

শূন্য কালের শুরু কবে এবং কীভাবে?

১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় যখন সংসদের শীতকালীন অধিবেশন তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছিল, তখন প্রশ্নকাল স্থগিত করা হয়েছিল। সেই সময় সাংসদরা অবিলম্বে মনোযোগ দেওয়া উচিত এমন বিষয়গুলি কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই উত্থাপন করতে শুরু করেন। তখন থেকেই এই প্রথা তৈরি হয়েছে। নবম লোকসভার স্পিকার রবি রায় এটিকে আরও সুসংহত রূপ দেন।

তিনি স্থির করেন যে সাংসদদের শূন্য কালে বিষয় উত্থাপন করার জন্য সেই দিন সকাল ১০টার মধ্যে নোটিশ দিতে হবে এবং স্পিকার বা চেয়ারম্যান স্থির করবেন কোন বিষয়গুলি নেওয়া হবে।

শূন্য কাল কখন এবং কীভাবে হয়?

লোকসভায় সময়

  • সকাল ১১টা থেকে ১২টা: প্রশ্নকাল
  • দুপুর ১২টা থেকে ১২:৩০টা: শূন্য কাল (Zero Hour)

রাজ্যসভায় সময় (২০১৪ সালের পর থেকে)

  • সকাল ১১টা থেকে: শূন্য কাল
  • সকাল ১২টা থেকে: প্রশ্নকাল

শূন্য কালের প্রক্রিয়া (Zero Hour Process)

  • নোটিশ দেওয়া: সাংসদদের সেই দিন সকাল ১০টার মধ্যে স্পিকার (লোকসভা) বা চেয়ারম্যান (রাজ্যসভা)-এর কাছে লিখিত নোটিশ দিতে হয়। এতে বিষয়টি স্পষ্ট থাকতে হবে।
  • বিষয়গুলির নির্বাচন: স্পিকার বা চেয়ারম্যান স্থির করেন যে কোন বিষয়গুলি শূন্য কালে উত্থাপন করা হবে।
    • লোকসভায় সর্বোচ্চ ২০ জন সাংসদ সুযোগ পান।
    • অগ্রাধিকার জনস্বার্থ, জরুরি বা সংবেদনশীল বিষয়গুলিকে দেওয়া হয়।
  • সময়সীমা: প্রত্যেক সাংসদ ২-৩ মিনিটের সময় পান। কখনও কখনও স্পিকার বা চেয়ারম্যান এটি বাড়াতেও পারেন।
  • সরকারি জবাবদিহিতা: মন্ত্রী চাইলে জবাব দিতে পারেন, কিন্তু প্রশ্নকালের মতো জবাব দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।

শূন্য কালের গুরুত্ব (Importance of Zero Hour)

  1. জনগণের বিষয়গুলির তাৎক্ষণিক শুনানি: সাংসদরা দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছাড়াই জনগণের সঙ্গে জড়িত গুরুতর বিষয় উত্থাপন করতে পারেন।
  2. সরকারের উপর চাপ: যেহেতু এই বিষয়গুলি তৎক্ষণাৎ উত্থাপিত হয়, তাই সরকারকে গুরুত্ব সহকারে শুনতে হয় এবং কখনও কখনও দ্রুত প্রতিক্রিয়া দিতে হয়।
  3. গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা: জনগণের বিষয় সরাসরি সংসদে উত্থাপন করা গণতন্ত্রের শক্তিকে দর্শায়।
  4. তাত্ক্ষণিক আলোচনার মঞ্চ: প্রশ্নকালের পর শূন্য কালই এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়গুলি বিনা দেরিতে সামনে রাখা যায়।

শূন্য কালের চ্যালেঞ্জ (Challenges of Zero Hour)

  • অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা: এটি সংসদের নিয়মের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই কখনও কখনও এর অপব্যবহারও হয়।
  • সীমিত সময়: মাত্র ৩০ মিনিটে সকল সাংসদকে সুযোগ দেওয়া কঠিন। এতে অনেক সময় অসন্তোষও সৃষ্টি হয়।
  • সংসদে ব্যাঘাত: কখনও কখনও আবেগপ্রবণ বা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয় থেকে সংসদের পরিবেশ উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে এবং কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

'শূন্য কাল' ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি সাংসদদের জনগণের আওয়াজ সরাসরি সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মঞ্চ তৈরি করে। যদিও এটি অনানুষ্ঠানিক, তবুও এর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব অনেক বেশি। এর ফলে সরকারের উপর জবাবদিহিতার চাপ বাড়ে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়।

Leave a comment