লাদাখে চীনের নজর এড়িয়ে ভারতের গোপন রাস্তা নির্মাণ: কৌশলগত সুবিধা ও নিরাপত্তা জোরদার

লাদাখে চীনের নজর এড়িয়ে ভারতের গোপন রাস্তা নির্মাণ: কৌশলগত সুবিধা ও নিরাপত্তা জোরদার

ভারত লাদাখের দৌলত বেগ ওল্ডি পর্যন্ত ১৩০ কিমি দীর্ঘ নতুন রাস্তা তৈরি করছে যা চীনের নজর থেকে দূরে থাকবে। এতে দূরত্ব ৭৯ কিমি কমবে এবং অস্ত্র ও সৈনিক দ্রুত পৌঁছতে পারবে।

Ladakh Secret Road: লাদাখে দৌলত বেগ ওল্ডি (DBO) পর্যন্ত ভারত একটি নতুন ১৩০ কিমি দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করছে। এই রাস্তাটি চীনা সেনাদের নজর থেকে দূরে থাকবে এবং লেহ থেকে DBO-এর দূরত্ব ৭৯ কিমি পর্যন্ত কমিয়ে দেবে। এই রাস্তাটি তৈরি হয়ে গেলে ভারতের সামরিক পৌঁছনোর ক্ষমতা দ্রুত বাড়বে এবং সেনা বাহিনীকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করতে সুবিধা হবে। BRO দ্বারা তৈরি করা এই রাস্তায় ৭০ টন পর্যন্ত ওজনের অস্ত্র নিয়ে যেতে সক্ষম পুলও তৈরি করা হচ্ছে। এই রাস্তা ২০২৬ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

DBO কেন ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ

দৌলত বেগ ওল্ডি (DBO) ভারতের সবচেয়ে উত্তরের সামরিক ঘাঁটি যা লাদাখের কারাকোরাম পাসের কাছে অবস্থিত। এই জায়গাটি লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (LAC) থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে। DBO-তে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এয়ারস্ট্রিপ রয়েছে, যেখান থেকে সেনা বাহিনীকে আকাশপথে সাহায্য সহজে পাঠানো যায়। এই অঞ্চলটি সাব-সেক্টর নর্থের অংশ, যেখানে ডেপসাং প্লেন এবং সিয়াচেন হিমবাহের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চল রয়েছে।

পুরোনো রাস্তা এবং তার সমস্যা

এখনো পর্যন্ত DBO-তে পৌঁছানোর একমাত্র রাস্তাটি হল দারবুক-শ্যোক-DBO (DSDBO) রাস্তা, যা প্রায় ২৫৫ কিমি দীর্ঘ। এই রাস্তাটি LAC-এর খুব কাছ দিয়ে গিয়েছে, যার ফলে চীনা সেনাদের নজরদারিতে থাকে। এই কারণে ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। চীন এই রাস্তা তৈরির ফলে তাদের স্থিতিতে বিপদ অনুভব করেছিল।

নতুন রাস্তার রুট এবং তার গুরুত্ব

নতুন রাস্তাটি সসোমা থেকে শুরু হয়ে সাসের লা, সাসের ব্রাংসা, গাপশান হয়ে DBO পর্যন্ত পৌঁছবে। এই রাস্তাটি প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এবং চীনের নজরদারি থেকে দূরে থাকবে। এর বিশেষত্ব হল এই রাস্তাটি লেহ থেকে DBO পর্যন্ত দূরত্ব ৩২২ কিমি থেকে কমিয়ে ২৪৩ কিমি করে দেবে এবং যাত্রার সময় দুই দিন থেকে কমিয়ে মাত্র ১১-১২ ঘণ্টা করে দেবে।

৭০ টন ক্ষমতার সেতু এবং অস্ত্রের সরবরাহ

এই নতুন রাস্তায় BRO ৯টি বড় সেতু তৈরি করেছে, যেগুলি প্রথমে ৪০ টন ক্ষমতা অনুসারে তৈরি করা হয়েছিল। এখন সেগুলোকে ৭০ টন ক্ষমতা পর্যন্ত আপগ্রেড করা হচ্ছে। এর মানে হল এখন বোফর্স কামান, ট্যাঙ্কের মতো ভারী সামরিক সরঞ্জাম সহজে DBO পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে।

সিয়াচেনের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের সুবিধা

এই রাস্তাটি সসোমা থেকে শুরু হয়, যা সিয়াচেন বেস ক্যাম্পের কাছে অবস্থিত। এর ফলে সিয়াচেন এবং DBO-এর মধ্যে সরাসরি এবং দ্রুত সংযোগ স্থাপিত হবে। এখন সৈন্যদের এবং সরঞ্জাম লেহ হয়ে যেতে হবে না, ফলে সময় এবং সম্পদের সাশ্রয় হবে।

রাস্তা নির্মাণের চ্যালেঞ্জ এবং প্রযুক্তিগত সমাধান

১৭,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতায় রাস্তা তৈরি করা একটি কঠিন কাজ। BRO-এর প্রায় ২০০০ কর্মী এই রাস্তায় দিনরাত কাজ করছেন। অক্সিজেনের অভাব এবং বছরভর বরফপাতের মতো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে BRO আধুনিক প্রযুক্তি যেমন জিওসেল ব্যবহার করছে, যা রাস্তাকে টেকসই এবং মজবুত করে তোলে।

সাসের লা-তে টানেল তৈরি হতে পারে

BRO সাসের লা পাসে একটি ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ (টানেল) তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এর ডিটেইলড প্রোজেক্ট রিপোর্ট (DPR) তৈরি হয়ে গেছে এবং ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ এর কাজ শুরু হতে পারে। টানেল তৈরি হয়ে গেলে এই রাস্তাটি সারা বছর খোলা থাকবে এবং সামরিক সরবরাহ কখনো বন্ধ হবে না।

প্রজেক্টের বিবরণ

এই রাস্তাটি দুটি পর্যায়ে তৈরি হচ্ছে:

প্রোজেক্ট বিজয়ক: সসোমা থেকে সাসের ব্রাংসা পর্যন্ত অংশ, যার খরচ ৩০০ কোটি টাকা এবং এটি তৈরি হয়ে গেছে।

প্রোজেক্ট হিমাঙ্ক: সাসের ব্রাংসা থেকে DBO পর্যন্ত অংশ, যার খরচ ২০০ কোটি টাকা এবং এর ৭০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

অক্সিজেন ক্যাফে এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা

শ্রমিকদের জন্য BRO অক্সিজেন ক্যাফে তৈরি করেছে। এগুলো এমন স্থান যেখানে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, যাতে শ্রমিকেরা অক্সিজেনের অভাবে হওয়া রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারে। এই সুবিধাটি খুব উঁচু অঞ্চলে কর্মরত কর্মীদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় প্রমাণিত হচ্ছে।

নিরাপত্তার জন্য নতুন রাস্তার গুরুত্ব

নতুন রাস্তাটি শুধু ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে সৈন্যদের দ্রুত মোতায়েন করতে সাহায্য করবে না, বরং এটি চীনের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখতে এবং পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। চীনা সেনাদের জন্য এই রাস্তাটি দৃষ্টিগোচর হবে না, ফলে ভারতীয় সেনাদের মুভমেন্ট গোপন থাকবে।

সিয়াচেন এবং ডেপসাংয়ের সুরক্ষাকে আরও জোরদার করা

DBO-এর অঞ্চল সিয়াচেন হিমবাহ এবং ডেপসাং প্লেনের কাছে অবস্থিত। যদি এই অঞ্চল ভারতের নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে সিয়াচেনের রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। নতুন রাস্তাটি এই এলাকাগুলোর রক্ষা এবং দ্রুত সরবরাহ করার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।

ভারতের অন্যান্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোজেক্ট

ভারত সীমান্ত অঞ্চলে দ্রুত ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করেছে:

ন্যোমা এয়ারবেস: ১৩,৭০০ ফুট উচ্চতায় নতুন এয়ারবেস তৈরি হচ্ছে যা ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে।

শিনকু লা টানেল: পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সুড়ঙ্গ হবে যা মানালি থেকে লেহকে জুড়বে।

অরুণাচল ফ্রন্টিয়ার হাইওয়ে: ১,৬৩৭ কিলোমিটার লম্বা এই হাইওয়ে LAC-এর পাশে থাকা ১২টি জেলাকে জুড়বে।

সেলা টানেল: অরুণাচলে এই টানেলটি সেনাদের দ্রুত মোতায়েন করতে সাহায্য করবে।

Leave a comment