উন্নয়নের বার্তা অধরাই দুর্গাপুরে প্রধানমন্ত্রীর সভার পর হতাশ শিল্পাঞ্চল

উন্নয়নের বার্তা অধরাই দুর্গাপুরে প্রধানমন্ত্রীর সভার পর হতাশ শিল্পাঞ্চল

শিল্পাঞ্চলের স্বপ্নভঙ্গ, মোদীর মুখে বিনিয়োগের আশা নেই

দুর্গাপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে শুনতে পাওয়া গেল না কোনও নতুন শিল্প গড়ার বার্তা বা বন্ধ কারখানাগুলিকে পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি। শুক্রবারের সভার আগে আশা ছিল, বিধানচন্দ্র রায়ের তৈরি এই শিল্পাঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলবেন মোদী। কিন্তু সেই প্রত্যাশা ভেঙে দিয়ে তিনি তুলে ধরলেন ইতিহাসের কিছু উল্লেখমাত্র। দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিধান রায়ের মতো নাম উঠে এলেও বাস্তব শিল্পচিত্র নিয়ে মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী। ফলে, নতুন বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থানের সম্ভাবনায় জল ঢেলে গেল তাঁর ভাষণ।

বিনিয়োগ নয়, শুনতে হল অতীত স্মৃতিচারণা

স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শুরু করে শিল্পমহল—প্রত্যেকে চেয়েছিল দুর্গাপুর, আসানসোল, রানিগঞ্জের মুখ থুবড়ে পড়া শিল্প ব্যবস্থার পুনর্জাগরণে কোনও রূপরেখা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পুরো বক্তব্যজুড়ে ছিল অতীত ইতিহাস, কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ইঙ্গিতমাত্রও মেলেনি। বণিকসভা ও শিল্প সংগঠনগুলির মতে, একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বন্ধ হয়ে যাওয়া, কয়লাখনি বন্ধের ঘটনায় ইতিমধ্যেই এই অঞ্চল মার খেয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে নেতাদের প্রত্যাশা ছিল মোদীর মুখে অন্তত একটি আশাব্যঞ্জক ঘোষণা। কিন্তু সে আশায় কার্যত জল ঢেলে দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।

‘শ্রমিকদের স্বার্থ নয়, পুঁজিপতিদের স্বার্থেই সরকার’— অভিযোগ সিপিএমের

সিপিএমের পশ্চিম বর্ধমান জেলা সম্পাদক ও প্রাক্তন বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মোদি সরকার যখন প্রথম ক্ষমতায় এল, তখনই হিন্দুস্তান কেবলস বন্ধ করল। এরপর বার্নপুরের বার্ন স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগনও বন্ধ হয়ে গেল। একে একে বন্ধ হয়েছে প্রায় কুড়িটি কয়লাখনি। এখন তো রেভিনিউ শেয়ারিং ও মাইনস ডেভেলাপার অপারেটরের নামে খনিগুলি তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে।” তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ, রেলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপি শাসিত রাজ্যে যন্ত্রাংশ তৈরির নতুন প্রকল্প চালু করছে, অথচ চিত্তরঞ্জনের মতো ঐতিহ্যবাহী কারখানাকে রূপান্তর করছে শুধুই অ্যাসেম্বলি ইউনিটে।

‘আমরা হতাশ নই, আশাও করিনি’— হিন্দ মজদুর সভার সাফ বার্তা

শুধু বাম নেতৃত্ব নয়, শ্রমিক সংগঠনগুলিও মনে করছে, এই সরকারের কাছ থেকে শ্রমিক স্বার্থে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। হিন্দ মজদুর সভার রাজ্য সম্পাদক শিউকান্ত পাণ্ডে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা একটুও হতাশ হইনি, কারণ ওঁর কাছ থেকে শ্রমিকস্বার্থে কোনও বার্তা আসবে—এমন আশাই ছিল না। গত দশ বছরে কুড়িটি কয়লাখনি বন্ধ হয়েছে, বারোটি তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি হাতে। ইন্দিরা গান্ধীর জাতীয়করণের নীতি ভেঙে সেই সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। এই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই শ্রমিকবিরোধী, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পবিরোধী।

শিল্পাঞ্চলের ভিত নড়ছে, অথচ শাসকের নজরে নেই?

আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের মানুষ বারবার বলে এসেছেন—এই অঞ্চলের ভাঙা কারখানা ও বন্ধ খনিগুলির চেহারা বদলানো ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মুখে সেই চিত্র অদৃশ্য। কোনও রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নাম করলেও মৌলিক শিল্প উন্নয়ন বা কর্মসংস্থানের বিষয় ছিল অনুপস্থিত। ফলে এই জনপদের হাজার হাজার শ্রমিক ও যুবকের কাছে মোদীর সভা একপ্রকার হতাশার প্রতিচ্ছবি হয়ে রইল।

রাজনৈতিক বার্তা থাকলেও নেই ‘অর্থনৈতিক’ আভাস

মোদি এদিন তৃণমূলকে নিশানা করলেও রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্র কী করছে, বা ভবিষ্যতে কী করতে চায়—তা একবারও বলেননি। অথচ রাজ্যে বিজেপির প্রসার ঘটাতে গেলে শিল্পাঞ্চলের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিনিয়োগ ও কাজের প্রতিশ্রুতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। রাজনৈতিক ভাষণে শান ছিল, কিন্তু অর্থনৈতিক বার্তা রইল না বললেই চলে। এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

Leave a comment