নির্যাতিতার নাম ফাঁস করায় বিতর্কে জড়ালেন আইপিএস, কিন্তু চিঠি দিলেই কি মিলবে নিঃশর্ত মুক্তি?

নির্যাতিতার নাম ফাঁস করায় বিতর্কে জড়ালেন আইপিএস, কিন্তু চিঠি দিলেই কি মিলবে নিঃশর্ত মুক্তি?

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ সংক্রান্ত ঘটনায় আইপিএস অফিসার বিনীত গোয়েল হঠাৎই খবরে। কেন? কারণ, তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে জনসমক্ষে বলে ফেলেছেন নির্যাতিতার নাম। এটি শুধুমাত্র আইন লঙ্ঘনই নয়, সংবেদনশীলতাকেও চরমভাবে আঘাত করেছে বলে মনে করছে সমাজের একটা বড় অংশ। বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। শুরু হয় জোড়া জনস্বার্থ মামলা। তবে মঙ্গলবার এক নাটকীয় মোড় নেয় গোটা ঘটনাটি, যখন বিনীত গোয়েল চিঠির মাধ্যমে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।এই চিঠিতে তিনি লেখেন, আমি ভারতের সংবিধান ও আইনের প্রতি দায়বদ্ধ। তবে ঘটনাচক্রে যে ভুলটি হয়েছে, তা একেবারে অনিচ্ছাকৃত। এর জন্য আমি দুঃখিত এবং নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী। এই বক্তব্যের পরে আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ সন্তুষ্ট হয় এবং মামলার নিষ্পত্তি ঘটে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই ক্ষমা কি ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে? নাকি প্রশাসনিক গাফিলতির পিঠ চাপড়ানি?

ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ পুলিশ আধিকারিকের এমন ভূমিকা ‘সম্মানহানিকর’

বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা এবং তাঁর ডিভিশন বেঞ্চ একেবারে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন—একজন পুলিশ অফিসারের পক্ষ থেকে এ ধরনের আচরণ শুধু অনভিপ্রেত নয়, বরং তা পদের সম্মানের বিরুদ্ধেও যায়। তাঁরা বলেন, একজন আইপিএস অফিসার, যিনি রাষ্ট্রের আইন রক্ষা করার শপথ নিয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে এমন গাফিলতি কাম্য নয়। এটি গোটা পুলিশ ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।এই পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বেঞ্চের তরফে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও উঠে আসে। বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডিজি যেন পুলিশ অফিসারদের জন্য ‘জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি’-র মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। যদি ইতিমধ্যেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে, তবে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এমন একটি উচ্চপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে গোটা পুলিশ প্রশাসনের জন্য ভবিষ্যতের নির্দেশনা বয়ে আনবে।

‘আমি আইন মানি, কিন্তু...’—বিনীত গোয়েলের চিঠিতে মানবিক আবেদন, না কি চতুর প্রতিরক্ষা?

বিনীত গোয়েলের পাঠানো চিঠিতে একদিকে যেমন আছে মানবিকতার ছোঁয়া, অন্যদিকে কিছু বিশেষজ্ঞ এটিকে দেখছেন ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ হিসেবে। চিঠিতে গোয়েল লেখেন, “ভারতের আইন মেনে চলা আমার কর্তব্য এবং আমি সর্বদা সেটাই করি। তবে সেদিন যা ঘটেছে, তা সম্পূর্ণরূপে অনিচ্ছাকৃত। আমি নিজে থেকে ওই তথ্য জনসমক্ষে আনতে চাইনি। যদি তাতে কারও মনে কষ্ট দিয়ে থাকি, তবে আমি বিনীতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।এই বক্তব্য থেকে এক ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের আভাস পাওয়া যায়। তিনি দোষ স্বীকার করছেন, তবে সেই দোষের উৎস হিসেবে নিজেকে দায়ী না করে পরিস্থিতিকে দায়ী করছেন। এর ফলে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এটি কি শুধুই দায় এড়ানোর কৌশল, নাকি সত্যিকারের অনুশোচনা?

আইনের চোখে কী বলছে ঘটনা? নির্যাতিতার পরিচয় প্রকাশ কি শুধুই অনিচ্ছাকৃত ভুল, না কি গুরুতর অপরাধ?

ভারতীয় আইন অনুযায়ী, ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার শিকার কোনও নারীর নাম বা পরিচয় প্রকাশ্যে আনা একেবারেই বেআইনি। এটি ভারতীয় দণ্ডবিধির ২২৮A ধারায় পরিষ্কারভাবে নিষিদ্ধ। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিনীত গোয়েলের অনিচ্ছাকৃত হলেও পরিচয় প্রকাশ অত্যন্ত গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। যদিও আদালত চিঠির ভিত্তিতে মামলার নিষ্পত্তি করেছে, তবে এই উদাহরণ যে ভবিষ্যতে অনেক আলোচনার জন্ম দেবে, তা বলাই বাহুল্য।আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, আইপিএস অফিসার বলেই হয়তো কিছুটা ছাড় পাওয়া গেল। সাধারণ কেউ এমন কাজ করলে কী হতো? তদন্ত, গ্রেফতার, মামলা—সবই হতো নির্দ্বিধায়।” তাই এই ঘটনাকে অনেকেই দেখছেন এক পক্ষপাতদুষ্ট বিচার ব্যবস্থার প্রতিফলন হিসেবেও।

চিঠিতে স্বস্তি পেলেও বিতর্কের শেষ নেই, প্রশাসনিক সতর্কতা বাড়ানোই একমাত্র পথ

এই ঘটনার মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রশাসনের গাফিলতি প্রকাশ পেল, অন্যদিকে হাইকোর্টের সংবেদনশীলতা এবং সচেতন দৃষ্টিভঙ্গিও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বিনীত গোয়েল হয়তো এই মামলায় আপাত স্বস্তি পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর এই ভুল আগামী দিনে বারবার টেনে আনা হবে প্রশাসনিক সচেতনতার পরিমাপক হিসেবে। এখন দেখার, রাজ্য সরকার পুলিশ অফিসারদের আইনজ্ঞান বৃদ্ধির দিকে কতটা গুরুত্ব দেয়।

Leave a comment