ঘরে ভগবান শিবের মূর্তি বা শিবলিঙ্গ রাখার সময় দিক, মুদ্রা এবং নিয়মাবলী সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে শান্ত মুদ্রার মূর্তি বা শিবলিঙ্গ স্থাপন করলে ঘরে ইতিবাচক শক্তি, সুখ এবং সমৃদ্ধি আসে। ভুল দিকে মূর্তি রাখলে বাস্তু দোষ উৎপন্ন হতে পারে।
শিবলিঙ্গ স্থাপন: হিন্দু ধর্মে ভগবান শিবকে শান্তি ও ভারসাম্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, ঘরে শিবলিঙ্গ বা শিবের মূর্তি রাখার আগে দিক এবং মুদ্রার প্রতি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে স্থাপিত শিবলিঙ্গ থেকে ঘরে সুখ-শান্তি এবং ইতিবাচক শক্তি আসে। অন্যদিকে, ভুল দিকে বা তাণ্ডব মুদ্রার মূর্তি রাখলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই, মূর্তি স্থাপনের আগে সঠিক দিক এবং নিয়মাবলী অনুসরণ করা অপরিহার্য।
ভগবান শিবের মূর্তির সঠিক দিক
বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, ভগবান শিবের মূর্তি উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে (ঈশান কোণ) রাখা সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়। এই দিকটি ভগবান শিবের জন্য নির্ধারিত এবং এর ফলে ঘরে সদ্ভাব, সুখ এবং ইতিবাচক শক্তি বজায় থাকে। মূর্তি এমনভাবে স্থাপন করা উচিত যাতে ভগবান শিবের মুখ দক্ষিণ দিকে থাকে। এই ব্যবস্থা ঘরে ইতিবাচক প্রবাহ বজায় রাখে এবং সকল দিকে শান্তির প্রভাব ছড়িয়ে দেয়।
শিবলিঙ্গ বা মূর্তি ঈশান কোণে রাখলে ঘরের বাস্তু ভারসাম্যপূর্ণ থাকে এবং নেতিবাচক শক্তির প্রভাব পড়ে না। বাস্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিবের কৃপায় এই দিকে রাখা মূর্তি বা শিবলিঙ্গ ঘরে স্থিতিশীলতা এবং সুখ-শান্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।
মূর্তির আকার ও স্বরূপ কেমন হওয়া উচিত
ঘরের মন্দিরে ভগবান শিবের মূর্তি খুব বড় হওয়া উচিত নয়। বাস্তুশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে 5 থেকে 8 ইঞ্চির মূর্তি সবচেয়ে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। খুব বড় মূর্তি ঘরের পরিবেশে অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং শক্তি প্রবাহে ভারসাম্যহীনতা আনতে পারে।
মূর্তির উপাদানও গুরুত্বপূর্ণ। পাথর, পিতল, স্ফটিক বা পঞ্চধাতু দিয়ে তৈরি মূর্তি শুভ ফলদায়ী হয়। এই ধাতুগুলি কেবল টেকসইই নয়, এগুলি থেকে নির্মিত মূর্তিগুলি দিব্য শক্তি সঞ্চার করে।
মূর্তির স্বরূপও শান্ত ও ধ্যানমগ্ন হওয়া উচিত। তাণ্ডব মুদ্রায় শিবের মূর্তি ঘরে রাখা নিষিদ্ধ, কারণ এই মুদ্রা শক্তিকে অস্থির করে তোলে। বাস্তু অনুসারে, ঘরে ধ্যানস্থ, শান্ত বা আশীর্বাদ প্রদানকারী মুদ্রায় শিবের মূর্তি সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়।

শিবলিঙ্গ স্থাপনের নিয়মাবলী
ঘরে শিবলিঙ্গ স্থাপন করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়, তবে এর জন্যও কিছু নিয়ম আছে যা পালন করা অপরিহার্য। বাস্তু অনুসারে, শিবলিঙ্গকে অবশ্যই উত্তর-পূর্ব দিকে স্থাপন করতে হবে। এর নিচে যোনিপীঠ অর্থাৎ ভিত্তি অংশ থাকা আবশ্যক। এটি শক্তির ভারসাম্যের জন্য জরুরি।
শিবলিঙ্গের জলাধার (জল নির্গমনের অংশ) সর্বদা উত্তর দিকে মুখ করে থাকা উচিত। এর কারণ হল উত্তর দিককে জল উপাদানের দিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা জীবন ও শান্তির প্রতীক।
শিবলিঙ্গের নিয়মিত পূজা করলে পরিবেশ শুদ্ধ থাকে। প্রতিদিন সকালে গঙ্গাজল, দুধ এবং বেলপত্র অর্পণ করা শুভ বলে মনে করা হয়। এতে ঘরে নেতিবাচক শক্তি দূর হয় এবং পরিবেশে শান্তি বজায় থাকে।
মূর্তি কোথায় এবং কীভাবে রাখবেন
ভগবান শিবের মূর্তি কখনোই সরাসরি মেঝেতে রাখা উচিত নয়। এটিকে সর্বদা কাঠ বা মার্বেলের ছোট মঞ্চে স্থাপন করুন। এমনটা করলে শক্তির প্রবাহ উন্নত হয় এবং মূর্তির সম্মানও বজায় থাকে।
ঘরে একাধিক শিবলিঙ্গ বা ভগবান শিবের মূর্তি রাখা উচিত নয়। বাস্তু অনুসারে, একাধিক মূর্তি রাখলে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এবং মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে।
একই সাথে, ভৈরব রূপ বা তাণ্ডব মুদ্রার শিব মূর্তি ঘরে রাখা উচিত নয়। এই রূপগুলি শক্তির প্রতীক হলেও, ঘরে এগুলি রাখলে উগ্র শক্তির প্রভাব বাড়তে পারে। তাই ঘরের মন্দিরের জন্য শান্ত মুদ্রার মূর্তিই উপযুক্ত।
শিবের মূর্তি এবং বাস্তু শক্তির সম্পর্ক
বাস্তুশাস্ত্রে ভগবান শিবকে ব্রহ্মাণ্ডীয় শক্তির কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাঁর মূর্তি বা শিবলিঙ্গের সঠিক স্থাপন ঘরে ভারসাম্য, স্থিতিশীলতা এবং ইতিবাচকতা বৃদ্ধি করে। বলা হয় যে, যেখানে ভগবান শিবের বাস, সেখানে নেতিবাচক শক্তি টিকতে পারে না।
শিবের উপস্থিতি ঘরের পরিবেশকে শান্ত করে তোলে। মানসিক চাপ, কলহ বা অস্থিরতার মতো পরিস্থিতিতে শিবের আরাধনা করলে মনে শান্তি এবং আত্মবিশ্বাস আসে। বাস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে এও বলা হয়েছে যে, শিবলিঙ্গের আশেপাশে সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা উচিত এবং সেখানে কোনো জুতো, অপবিত্র জিনিস বা আবর্জনা রাখা উচিত নয়।
ঘরে শিবলিঙ্গ রাখার সুবিধা
- ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার: সঠিক দিকে শিবলিঙ্গ রাখলে ঘরে ইতিবাচক শক্তির প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং নেতিবাচকতা দূর হয়।
- সুখ-শান্তির বসবাস: ঈশান কোণে শিবলিঙ্গ স্থাপন করলে পরিবারে সদ্ভাব, প্রেম এবং মানসিক শান্তি বজায় থাকে।
- ধন ও সমৃদ্ধির বৃদ্ধি: বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, শিবের কৃপায় ঘরে আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী হয় এবং বাধাগুলি কমে আসে।
- স্বাস্থ্যের উন্নতি: প্রতিদিন শিবলিঙ্গে জল অর্পণ এবং মন্ত্র জপ করলে মন ও শরীর উভয়ই সুস্থ থাকে।
- পারিবারিক ঐক্য: শিব পরিবারের প্রতীক হওয়ায়, ঘরে শিবলিঙ্গ রাখলে পরিবারে ঐক্য এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি পায়।
মূর্তির যত্নের নিয়মাবলী
- শিবলিঙ্গ বা মূর্তি প্রতিদিন পরিষ্কার করুন।
- প্রতি সোমবার গঙ্গাজল বা দুধ দিয়ে অভিষেক করুন।
- পূজার সময় প্রদীপ উত্তর-পূর্ব দিকে জ্বালান।
- মূর্তির কাছে অন্য কোনো দেবতার বড় প্রতিমা রাখবেন না, যাতে শক্তি কেন্দ্রীভূত থাকে।
- পূজা স্থানের আশেপাশে সর্বদা শান্ত পরিবেশ বজায় রাখুন।
শিব উপাসনার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
ভগবান শিবকে মহাদেব বলা হয় কারণ তিনি সৃষ্টি, পালন এবং সংহার—এই তিনেরই প্রতীক। তাঁর পূজা কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, আধ্যাত্মিক ভারসাম্যের জন্যও করা হয়। বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, ঘরে শিবের উপস্থিতি মনকে কেন্দ্রীভূত করে, চিন্তাভাবনাকে শান্ত করে এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সদ্ভাব বৃদ্ধি করে।
গৃহস্থ জীবনে শিবের আরাধনা করলে আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্য বৃদ্ধি পায়। বলা হয় যে, যে ব্যক্তি প্রতি সোমবার শিবলিঙ্গে জল অর্পণ করেন, তিনি মানসিক শান্তি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা লাভ করেন।













