ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ভারতীয় সামুদ্রিক পণ্যের জন্য একটি বড় স্বস্তি নিয়ে এসেছে। এই চুক্তির আওতায় এখন থেকে ব্রিটেনে ভারতীয় সিফুডের অনেক পণ্যের উপর আরোপিত আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে। আগে এইগুলির উপর ২১.৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স লাগত। এখন এগুলিকে ‘এ শ্রেণী’-তে রাখা হয়েছে, যার মানে হল এগুলির উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক ছাড় পাওয়া যাবে।
এই পরিবর্তনের ফলে ভ্যান্নামী চিংড়ি, ফ্রোজেন পমফ্রেট, লবস্টার এবং ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির মতো পণ্যের ব্রিটেনে চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত বর্তমানে ব্রিটেনকে ১০.৪ কোটি ডলারের সামুদ্রিক পণ্য রফতানি করে, যার মধ্যে ৭৭ শতাংশই হল হিমায়িত চিংড়ি।
ব্রিটেনের বাজারে ভারতের দখল বাড়ানোর সুযোগ
যদিও ব্রিটেনের সিফুড বাজারের মোট আকার প্রায় ৫.৪ বিলিয়ন ডলার, তবে এতে ভারতের অংশীদারিত্ব এখনও মাত্র ২.২৫ শতাংশ। শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, শুল্ক তুলে নেওয়ার ফলে ভারতের অংশীদারিত্ব দ্রুত বাড়বে। অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী কয়েক বছরে ভারত থেকে ব্রিটেনে সিফুড রফতানি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
ভারতের জন্য এই চুক্তি শুধু বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যম নয়, বরং দেশের মৎস্যপালন এবং জলজ কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং উৎপাদনকে উৎসাহিত করারও একটি সুযোগ।
গ্রামীণ অর্থনীতি পাবে সহায়তা
কম্পাউন্ড লাইভস্টক ফিড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান দিব্য কুমার গুলাটি জানিয়েছেন যে এই চুক্তি ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুযোগ প্রমাণ হতে পারে। এর ফলে শুধুমাত্র মহিলাদের কৃষি প্রক্রিয়াকরণে অংশগ্রহণ বাড়বে না, পশু প্রোটিন শিল্পে মূল্য সংযোজনের প্রক্রিয়াও দ্রুত হবে।
গুলাটির মতে, এই চুক্তি ভারতের রফতানি-ভিত্তিক কৃষি মডেলকে শক্তিশালী করবে এবং ছোট স্তরে কর্মরত মৎস্যজীবী ও কৃষক গোষ্ঠীগুলিকেও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত করতে সাহায্য করবে।
আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা
ভারতের জন্য আমেরিকা এখনও সবচেয়ে বড় সিফুড রফতানি বাজার, কিন্তু গত কয়েক মাসে আমেরিকার সঙ্গে রফতানি নিয়ে অনিশ্চয়তা বজায় রয়েছে। শুল্ক নিয়ে চলমান দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে অনেক ভারতীয় রফতানিকারককে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, ব্রিটেনের সঙ্গে নতুন চুক্তি ভারতের জন্য একটি বিকল্প বড় বাজার তৈরি করতে পারে।
মালদ্বীপের সঙ্গে অংশীদারিত্বে পরিকাঠামোকে উৎসাহ
ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তির পাশাপাশি ভারত মালদ্বীপের সঙ্গেও একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হল মালদ্বীপে মাছের কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা তৈরি করা, হ্যাচারি নির্মাণ করা এবং উচ্চ মানের প্রজাতির চাষ বৃদ্ধি করা।
মালদ্বীপের মৎস্যপালন ক্ষেত্রটি মূলত টুনা মাছের উপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে স্কিপজ্যাক টুনা এবং ইয়েলোফিন টুনার ৯৮ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে। ২০১৫ সালে মালদ্বীপের ১১ শতাংশ মানুষ এই ক্ষেত্রে কর্মরত ছিল। ভারতের সঙ্গে চুক্তির ফলে মালদ্বীপ তাদের মৎস্য ক্ষেত্রের পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য পাবে এবং ভারত তার প্রযুক্তি ও সম্পদের মাধ্যমে এই উন্নয়নে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে।
সিফুড রফতানিতে ক্রমাগত বৃদ্ধি
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ সালে ভারত ৭.৩৮ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৬০,৫০০ কোটি টাকার সিফুড বিশ্বের অনেক দেশে রফতানি করেছে। এটি ১৭.৮ লক্ষ টনের সমান ছিল। এই রফতানিতে চিংড়ি, লবস্টার, স্কুইড, কাটলফিশের মতো পণ্যের প্রধান ভূমিকা ছিল। এই বৃদ্ধি দেখে এটা স্পষ্ট যে ভারতের সামুদ্রিক খাদ্য শিল্প বিশ্ব বাজারে দ্রুত নিজেদের স্থান করে নিচ্ছে।
কোল্ড চেন এবং প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের উপর জোর
মালদ্বীপের সঙ্গে হওয়া চুক্তিতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে কোল্ড চেন এবং প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের উন্নয়নের উপর। এর ফলে মাছের অপচয় কমবে এবং তাদের গুণগত মানও ভাল থাকবে। এর সাথে সাথেই মৎস্যজীবীরা তাদের মাছ বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করে ভালো দাম পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ পাবেন।
এই পরিকাঠামোর উন্নয়নে ভারতের পক্ষ থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও বিশেষজ্ঞতা শেয়ার করা হবে, যা উভয় দেশকেই সমানভাবে উপকৃত করবে। এর ফলে আঞ্চলিক সামুদ্রিক পণ্যের গুণমান এবং রফতানি ক্ষমতাতেও উন্নতি হবে।
পরিবর্তনশীল বাজারে ভারতীয় সিফুডের ক্রমবর্ধমান চাহিদা
আজকের সময়ে স্বাস্থ্যকর এবং উচ্চ প্রোটিন ডায়েট সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এর প্রভাব সিফুডের ভোগের উপর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশ এবং আমেরিকাতে চিংড়ি, টুনা এবং অন্যান্য মাছের চাহিদা দ্রুত বেড়েছে। ভারত, তার বিশাল সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল এবং উন্নত মৎস্যপালন প্রযুক্তির কারণে এই চাহিদা পূরণ করার অবস্থানে রয়েছে।
ব্রিটেন ও মালদ্বীপের সঙ্গে হওয়া নতুন চুক্তি থেকে এটা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ভারত এখন শুধু কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রেই নয়, সামুদ্রিক পণ্যের রফতানিতেও বিশ্ব মঞ্চে বড় ভূমিকা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
সরকার ও শিল্প উভয়ই সক্রিয়
ভারত সরকার মৎস্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন নিয়ে বেশ সক্রিয়। এই দিকে সম্প্রতি অনেক পরিকল্পনা এবং উৎসাহ প্যাকেজও ঘোষণা করা হয়েছে। এখন যখন আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পথ পরিষ্কার হচ্ছে, তখন শিল্প জগতও নতুন বাজারে নিজেদের জায়গা করে নিতে উৎসাহিত।