ভারতীয় শেয়ার বাজারে বড় পতন: বিনিয়োগকারীদের ৫ লাখ কোটি টাকা লোকসান, কারণ ট্রাম্পের নীতি ও ডলারের মজবুতি

ভারতীয় শেয়ার বাজারে বড় পতন: বিনিয়োগকারীদের ৫ লাখ কোটি টাকা লোকসান, কারণ ট্রাম্পের নীতি ও ডলারের মজবুতি

গত চার দিনে সেনসেক্স এবং নিফটি প্রায় ১.৫% কমে গেছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। এই পতনের কারণ শুধু মার্কিন ভিসা ফি বৃদ্ধি এবং শুল্ক নয়, বরং ডলারের মজবুতি, টাকার দরপতন, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিক্রি, অপরিশোধিত তেলের ক্রমবর্ধমান দাম এবং আইটি শেয়ারের উপর চাপও এর জন্য দায়ী।

শেয়ার বাজার: সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর দ্বিতীয় সপ্তাহে বৃদ্ধির পর ভারতীয় শেয়ার বাজারে ব্যাপক চাপ দেখা গেছে। ১৮ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেনসেক্স ১,২৯৮ পয়েন্ট এবং নিফটি ৩৬৬ পয়েন্ট কমেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এইচ১বি ভিসা ফি বৃদ্ধি এবং শুল্ক সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের মনোভাব দুর্বল করেছে। এছাড়াও, টাকার রেকর্ড সর্বনিম্ন দর, বিদেশী পুঁজির বহির্গমন, অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি এবং আইটি কোম্পানিগুলির খরচ বাড়ার আশঙ্কাও বাজারকে টেনে নামিয়েছে।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রভাব

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এইচ১বি ভিসা ফি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভারতের আইটি কোম্পানিগুলোর ওপর। যেহেতু এইচ১বি ভিসা সবচেয়ে বেশি ভারত থেকে ব্যবহৃত হয়, তাই সেখানে কর্মরত ভারতীয় প্রযুক্তি সংস্থা এবং তাদের কর্মীদের উপর অতিরিক্ত বোঝা বেড়েছে। এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

জিএসটি সংস্কারের প্রভাব কমেছে

সেপ্টেম্বরের শুরুতে জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠক এবং ট্যাক্স স্ল্যাব কমার আশায় শেয়ার বাজার দারুণ গতি পেয়েছিল। ২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেনসেক্স ৩.৫৬ শতাংশ এবং নিফটি ৩.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই বৃদ্ধিতে বিনিয়োগকারীরা প্রচুর লাভ করেছিলেন। কিন্তু ভিসা ফি বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে এই গতি স্থায়ী হয়নি এবং অর্ধেকের বেশি বৃদ্ধি হারিয়ে গেছে।

আইটি শেয়ারের উপর চাপ

ভারতের বড় আইটি কোম্পানি যেমন টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো, টেক মহিন্দ্রা এবং এইচসিএল টেকের শেয়ার ক্রমাগত পতন দেখতে পাচ্ছে। ভিসা ফি বাড়ার কারণে এই কোম্পানিগুলির খরচ বাড়বে, যার ফলে তাদের আয় প্রভাবিত হতে পারে। এই কারণেই বিনিয়োগকারীরা আইটি শেয়ার থেকে লাভ তুলে নেওয়া শুরু করেছেন।

বাজারের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের টাকা তুলে নেওয়া। সেপ্টেম্বরের মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজার থেকে ১১,৫৮২ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত পুঁজি বাজার থেকে মোট ১,৪২,২১৭ কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ক্রমাগত বিক্রির কারণে বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

টাকার রেকর্ড সর্বনিম্ন স্তর

ডলারের বিপরীতে টাকা ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। বর্তমান স্তর ৮৮.৭৫-এ পৌঁছেছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এটি শীঘ্রই ৮৯ এবং ৯০-এর স্তর অতিক্রম করতে পারে। চলতি বছরে টাকার মান এখন পর্যন্ত ৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে। টাকা দুর্বল হওয়ার প্রভাব সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এবং আমদানির উপর পড়ে, যার ফলে বাজারের উপর চাপ আরও বেড়ে যায়।

ডলার এবং অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি

সাম্প্রতিক দিনগুলিতে ডলার সূচকে উন্নতি দেখা গেছে। গত পাঁচ কার্যদিবসে এতে ০.৫০ শতাংশ এবং তিন মাসে ০.৭০ শতাংশ বৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছে। ডলারের মজবুতি উঠতি বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের টাকা তুলে নিতে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে আবারও ব্যারেল প্রতি ৭০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত-এর মতো আমদানিকারক দেশের জন্য এই পরিস্থিতি আরও সমস্যা তৈরি করছে।

জিএসটি সংস্কারের পর শেয়ার বাজারে তেজি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এরপরেই বিনিয়োগকারীরা লাভ তুলে নেওয়া শুরু করেন। বিশ্বব্যাপী চলমান বাণিজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এই লাভ তুলে নেওয়াকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার নীতি পরিবর্তনও বাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক ক্ষতি

গত চার কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীরা বড় ধাক্কা খেয়েছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর বিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪,৬৫,৭৩,৪৮৬.২২ কোটি টাকা। ২৪ সেপ্টেম্বর এটি কমে ৪,৬০,৫৬,৯৪৬.৮৮ কোটি টাকা হয়ে গেছে। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীদের ৫,১৬,৫৩৯.৩৪ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। যেখানে জিএসটি সংস্কারের পর বিনিয়োগকারীরা ১২ লাখ কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছিলেন।

Leave a comment